করোনার চেয়েও বেশি মৃত্যু অপঘাতে

বিশ্বে এখন বড় আতঙ্কের নাম প্রাণঘাতী মহামারি নভেল করোনাভাইরাস। এই করোনায় প্রতিদিন বহু মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে।

টিকা এলেও সেভাবে কমছে না উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নতুন শক্তি সঞ্চয় করে হানা দিচ্ছে করোনা। দেড় বছরের বেশি সময় বিশ্ব মোকাবিলা করছে কোভিড মহামারি।

এ থেকে বাংলাদেশও বাইরে নয়। এতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে মারা গেছে ২৩ হাজার ৬১৩ জন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার মারা গেছে ২১৫ জন।

মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেই সবার মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়ে। কিন্তু মহামারির বাইরে অপঘাতেও বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে। এ নিয়ে তেমন একটা তোলপাড় হয় না। এমনকি এ ধরনের অনেক ঘটনার পরিসংখ্যানগত তথ্যও মানুষের জানা নেই।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। আর পৃথিবীতে বজ্রপাতে যত সংখ্যক মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। দেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত বজ্রপাত বেশি হয়। অনেক সময় মৌসুম শেষে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।

কিন্তু এ মৌসুমে এ ধরনের ঘটনা খুবই কম। যদিও শিবগঞ্জের ঘটনা অনেক বড়। তার মতে, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশ কৃষক। সচেতনতা, বাসাবাড়িতে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিং-এর ব্যবস্থা এবং মাঠেঘাটে গাছ রোপণ করে (যা উঁচু হবে) এই দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যেতে পারে।

যেসব দুর্ঘটনা বা অপঘাতে বাংলাদেশে অপমৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে সেগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চ ও ট্রলারডুবি এবং পাহাড়চাপায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশ উদ্বেগজনক।

এছাড়া আত্মহত্যা, সাপের কামড়, বজ্রপাত এবং পানিতে ডুবেও বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। আছে ট্রেন থেকে পড়ে বা রেললাইনে হাঁটতে গিয়ে কাটা পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাও। এসব অপমৃত্যুর মধ্যে কেবল পানিতে ডুবেই বছরে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। অথচ গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে এ বছরের ১৬ মার্চ পর্যন্ত এক বছরে করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮৫৭১ জন।

সাধারণত মানুষের যে মৃত্যু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নয়, সেটাকে অপমৃত্যু বা অপঘাতে মৃত্যু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। উল্লিখিত ঘটনাগুলোয় প্রতিবছর শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। এ ধরনের মৃত্যু পুলিশের খাতায় অপমৃত্যু হিসাবে রেকর্ডভুক্ত হয়ে থাকে।

এছাড়া এসব মৃত্যুকে বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, যেসব ঘটনায় মানুষের অপমৃত্যুর ঘটনা আছে সেগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে পানিতে ডোবা, সড়ক দুর্ঘটনা, বজ্রপাত ও সাপের কামড়। যদিও ২০১৬ সালের পর পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা নিরূপণ করা হয়নি।

এ বছর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের উদ্যোগে বৈশ্বিকভাবে ‘বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হয়। এই দিবসটি উদ্যাপনের প্রস্তাবক বাংলাদেশ। গুরুত্ব বিবেচনা করে বিশ্ব এই দিবসটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২৫ জুলাই এই দিবসটি পালন করা হয়। আর এর ফলোআপ কর্মসূচি ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে। আর ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করেছে।

সেই বছরে প্রায় ১৯ হাজার শিশু-কিশোর এ ঘটনায় মারা গেছে। এত বড় ঘটনা নিয়ে তেমন হইচই হয় না, যা থাকছে মানুষের নজরের বাইরে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে বিভিন্ন ধরনের অপঘাতের ও অপমৃত্যু রোধ সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী দুই লাখ ৩৬ হাজার মানুষ প্রাণ হারায় পানিতে ডুবে। বন্যা ও জলযান দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ঘটনা পানিতে ডুবে মৃত্যুর হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আর জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পানিতে ডুবে মোট মৃত্যুর ৯০ শতাংশেরও বেশি ঘটে থাকে নিু ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। এশিয়া ও আফ্রিকায় পানিতে ডুবে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।

সাধারণত বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে অধিকসংখ্যক শিশু-কিশোর পানিতে ডুবে মারা যায়। বিশ্বে শিশু মৃত্যুর ১০টি প্রধান কারণের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু অন্যতম।

বাংলাদেশসহ বেশির ভাগ নিচু ও মধ্যম আয়ের দেশে এক-চার বছর বয়সি শিশু সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, এরপর রয়েছে ৫-৯ বছর বয়সি শিশু।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২০-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার পরে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা দ্বিতীয় প্রধান ঘাতক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় পরিচালিত ২০১৬ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতিবছর সব বয়সি প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে তিন-চতুর্থাংশের বেশি ১৮ বছরের কম বয়সি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া।

অপঘাতে মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে। ৮ জানুয়ারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, ২০২০ সালে (এক বছরে) সড়কে ৫৪৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে দেশে চার হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় তথ্য রেকর্ড করেছে সংগঠনটি। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন সাত হাজার ৩৭৯ জন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংগঠনটির তথ্যের উৎস বলে জানিয়েছেন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান। তিনি জানান, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ। প্রাণহানি বেড়েছে চার দশমিক ২২ এবং আহত তিন দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত বছর করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দুই মাসের সাধারণ ছুটির সময় দেশে গণপরিবহণ বন্ধ ছিল। মানুষের চলাচল ছিল নিয়ন্ত্রিত। এরপরও দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। গণপরিবহণ বন্ধ না থাকলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ব্যবধান আরও বেশি হতো বলে ধারণা তার।

৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে একটি মালবাহী কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। পরের দিন পর্যন্ত ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করার খবর পাওয়া যায়। এছাড়া বেশ কয়েকজন নিখোঁজ ছিল। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আরও জানায়, ২০২০ সালে বছরব্যাপী ১১৯টি নৌদুর্ঘটনায় ২৭২ জন নিহত এবং ১৩৭ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় নিখোঁজ আছেন ৬২ জন। আর ১০৮টি রেলপথ দুর্ঘটনায় নিহত ২২৮ জন এবং আহত ৫৪ জন।

বেসরকারি গবেষণা অনুযায়ী, ২০ বছরে বাংলাদেশের নৌপথে বড় ১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। জানা যায়, বেশকিছু ঘটনায় দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটি আর তোলা সম্ভব হয় না। এর ধ্বংসাবশেষ কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে কোনো কোনো দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রকৃত তথ্যও মিলে না।

ভাটির দেশে অপঘাতে মৃত্যুর আরেক কারণ সাপের কামড়। প্রতিবছর আনুমানিক ছয় লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। আর এতে মারা যান ছয় হাজার মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বন্যার পানিতে ডুবে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ সাপের কামড়। আর বিষধর সাপ কামড় দেওয়ার পর বেঁচে যাওয়া অনেকে বিভিন্ন ধরনের পঙ্গুত্ববরণ ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন। বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে বর্ষাকালে সাপের কামড়ের ঘটনা বেড়ে যায়। বর্তমানে সাপের কামড়ের বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক চিকিৎসা আছে। তবু এখনো সাপের কামড় সম্পর্কে মানুষের মধ্যে চিকিৎসায় অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্ত ও চর্চা বিদ্যমান।

২০১৭ সালের দিকে ট্রেনে কাটা পড়ে বা রেললাইনে নিয়ে হত্যার ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল। ওই বছরের এক হিসাবে দেখা যায়, ‘ট্রেনে কাটা’ পড়ে এক বছরে নিহত হয় প্রায় ২ হাজার ১০০ মানুষ। এর আগের পাঁচ বছরে কাটা পড়া, খুনসহ বিভিন্নভাবে ৪ হাজার ৪৫৪ জন মারা যাওয়ার তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। ১৮৯০ সালের রেল আইনে রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুটের মধ্যে মানুষের চলাচল দূরের কথা, গরু-ছাগল প্রবেশও নিষিদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, রেলে কাটা পড়ে আহত কেউ বেঁচে গেলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে রেলওয়ে। এসব কঠোর নিয়ম বাস্তবায়ন করা হলে দুর্ঘটনা কমত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অপঘাতে মৃত্যুর আরেক কারণ বজ্রপাত। গত ৪ আগস্ট উত্তরাঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পদ্মা নদীর পাড়ে বজ্রপাতের একটি ঘটনায় ১৮ জন মারা গেছেন। বেসরকারি এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুনে প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এবারের মৌসুমে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছেন ১৭৭ জন। এর মধ্যে জুনের প্রথম সপ্তাহেই মারা গেছেন ৬৫ জন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম এ তথ্য জানিয়েছে। সংগঠনটি জানায়, উল্লিখিতদের মধ্যে ১২২ জনই বজ্রপাতের সময়ে কৃষিকাজে মাঠে কাজ করছিলেন। এ সময়ে আহত হয়েছেন ৪৭ জন।

দেশে ২০১১ সালের পর বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ক্রমেই বাড়ছিল। যে কারণে সরকার ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাত বছরে বজ্রপাতে সারা দেশে ১ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ডিজাস্টার ফোরাম নামে একটি সংগঠনের গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মোট ৭৩ জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ২৮ জন। যদিও ওই মৌসুমে ১৫৫ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৮ সালে বজ্রপাতে নিহতের ঘটনা ঘটে ২৭৭টি। ২০২০ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ১৭৭ জন মারা গেছে বলে বিভিন্ন হিসাবে জানা যাচ্ছে। আর দেশি-বিদেশি গবেষণা অনুযায়ী, দেশে গত কয়েক বছরে কালবৈশাখীর পাশাপাশি বজ্রপাতের হার বেড়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালে শুধু এপ্রিল-মে মাসেই বজ্রপাত বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।

 

সূত্রঃ যুগান্তর