করোনাভাইরাস: বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক-আইসিইউ-হাসপাতাল শয্যা কতোটা আছে?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই সবার দৃষ্টি পড়েছে এ রকম একটি স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় দেশটির স্বাস্থ্য অবকাঠামো ঠিক কতটা প্রস্তুত সেই দিকে।

আজ বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে ৩৯ জন আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর)।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে ঢাকায় আটটি হাসপাতালের নাম জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ, যদিও সবগুলো হাসপাতাল এখনো পুরোপুরি প্রস্তুতি শেষ করতে পারেনি বলে জানা যাচ্ছে।

ঢাকার বাইরে প্রতিটা জেলা শহরের হাসপাতালগুলো আইসোলেশন ইউনিট খোলা হলেও, খবর পাওয়া গেছে যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও প্রস্তুতির অভাব রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) বেনজীর আহমেদ বিবিসিকে বলেছেন, ”ধরুন বাংলাদেশে ষোল কোটির মানুষের ১০ শতাংশের মধ্যেও যদি রোগটি ছড়ায়, সেটা হবে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে যদি পয়েন্ট ফাইভ, পয়েন্ট ফোর বা পয়েন্ট ওয়ান পার্সেন্ট মানুষের অবস্থা গুরুতর হয়, তাহলে আমরা হাসপাতালে আর চিকিৎসা করতে পারবো না।”

“এতো আইসিইউ, এতো ফ্যাসিলিটিজ আমাদের নেই” – একেবারে নির্দিষ্ট করেই তিনি জানালেন।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা চার লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, মৃতের সংখ্যা এখন ২০ হাজারের কাছাকাছি।

করোনাভাইরাসে যারা গুরুতরভাবে সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের প্রয়োজন ভেন্টিলেটর। সমস্যা হচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই এ রকম একটি কঠিন সময়ে এই ভেন্টিলেটরের প্রচণ্ড অভাব পড়েছে।

আমেরিকাসহ ইউরোপের উন্নত ও ধনী দেশগুলোতেও যথেষ্ট সংখ্যায় এই যন্ত্রটি নেই। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের হাসপাতাল থেকেও বলা হচ্ছে যে শুধুমাত্র ভেন্টিলেটর না থাকার কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অনেক রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশে হাসপাতালের সংখ্যা

সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১,৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫,০৫৫টি, যেখানে মোট শয্যার সংখ্যা ৯০,৫৮৭টি।

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে অনুমিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ।

সেই হিসাবে প্রতি ১,১৫৯ জন ব্যক্তির জন্য হাসপাতালে একটি শয্যা রয়েছে।

আইসিইউর সংকট

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অসুস্থতা গুরুতর হয়ে উঠলে শ্বাসকষ্ট বা ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। চীন, ইতালিসহ যেসব দেশে বেশি রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, সেখানে নিউমোনিয়া, ফুসফুসের জটিলতার কারণেই বেশিরভাগ রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার এক পর্যায়ে এই রোগীদের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা যায়।

দেশের সরকারি-বেসরকারি বেশিরভাগ হাসপাতালেই নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) প্রয়োজনের তুলনায় শয্যার সংকট রয়েছে।

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১,১৬৯টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ৪৩২টি (ঢাকায় ৩২২, ঢাকার বাইরে ১১০) আর বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছে ৭৩৭টি (ঢাকা মহানগরীতে ৪৯৪, ঢাকা জেলায় ২৬৭, অন্যান্য জেলায় ২৪৩)।।

চিকিৎসক

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত মোট চিকিৎসকের সংখ্যা বর্তমানে ২৫,৬১৫ জন।

আর চিকিৎসক, সেবিকা ও নানা পর্যায়ের হাসপাতাল কর্মী মিলে মোট জনবল কর্মরত রয়েছেন ৭৮,৩০০ জন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে নিবন্ধিত মোট চিকিৎসকের সংখ্যা ৯৩,৩৫৮ জন। আর নিবন্ধিত দন্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ৯,৫৬৯ জন।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যবস্থা

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ঢাকায় আটটি হাসপাতালসহ প্রতিটি জেলা শহরে অন্তত একটি হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত রাখার কথা ঘোষণা করেছে সরকার।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীর আটটি হাসপাতাল এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি।

আর ঢাকার বাইরের যেসব হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে বলে বলা হচ্ছে, এমন অনেক স্থানে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন।

এ ধরণের বেশিরভাগ হাসপাতালেই আইসিইউ সুবিধা নেই। চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত পার্সোনেল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) নেই বলেও অভিযোগ রয়েছে।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ঢাকা মহানগরীতে আইসোলেশন শয্যার সংখ্যা ১,০৫০। এসব হাসপাতালে ২৯ শয্যার আইসিইউ সুবিধা রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীর বাইরে ঢাকার অন্যান্য জেলায় আইসোলেশন বিছানার সংখ্যা ২২৭, চট্টগ্রামে ৪৪১, রাজশাহীতে ৫৫৮, বরিশালে ৪২৯, রংপুরে ৫২৫, সিলেটে ৬৬৪, ময়মনসিংহ ৯০, খুলনায় ৫৩১।

ইতালির করোনাভাইরাসের বিস্তার বৃদ্ধি পাওয়ার পর এক পর্যায়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হলেও সবাইকে চিকিৎসা দিতে পারেনি দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ।

ইতালিতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথম সারিতে থাকা চিকিৎসকরা বলেছেন, এত রোগীর ভিড় যে কাদের তারা বাঁচানোর চেষ্টা করবেন এবং কাদের ফেলে রাখবেন তা তাদেরকে বেছে নিতে হচ্ছে। কারণ সব রোগীর জন্য সেখানে পর্যাপ্ত নিবিড় পরিচর্যার বিছানা নেই। ইতালিতে ৫,২০০ নিবিড় পরিচর্যা শয্যা থাকার পরেও সেখানে সব রোগীকে জায়গা দেয়া যায়নি।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেলে চিকিৎসা সেবা দিতে বাংলাদেশ কতোটা প্রস্তুত?

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় দাবি করছেন যে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তারা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছেন।

আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, ”স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই বিষয়ে সমস্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে এবং প্রতিদিনই সেটা আরো ভালো অবস্থানে নেয়া হচ্ছে। আস্তে আস্তে যেহেতু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমরা পরবর্তী স্তরের দিকে যাচ্ছি।”

তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, সারা বিশ্বে ভাইরাসটির বিস্তার তিনমাস পার হয়ে গেলেও চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ও হাসপাতাল প্রস্তুতের ব্যাপারে এখনো বাংলাদেশের অনেক ঘাটতি রয়েছে।