করোনাভাইরাসে কাবু দেশের অর্থনীতি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

করোনাভাইরাসের সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে। টানা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি প্রায় বন্ধ। ইতিমধ্যে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ফলে চীন থেকে আসা সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। তবে চীনের আশ্বাস- দ্রুতই সংকট কেটে যাবে। এতে আস্থা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। চীনের কারণে শুধু বাণিজ্যে প্রভাব ছিল; কিন্তু এ ভাইরাস কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ায় রেমিটেন্সে (প্রবাসী আয়) নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে- এমন আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা সমস্যা সমাধানে যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন।

জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সোমবার বলেন, চীনের পর কোরিয়াও ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কারণ চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যের পরিমাণ বিশাল।

বিশেষ করে গার্মেন্টস পুরোটাই চীনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। এছাড়া সমস্যা হচ্ছে চামড়া শিল্পেও। দ্বিতীয়ত সেবাখাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু চীনে নয় যে কোনো যে দেশের ক্ষেত্রে মানুষ বিমানে উঠতে ভয় পায়।

এছাড়াও ট্রাভেল ও হোটেল ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দেশে আমদানি-রফতানি কমছে। সামগ্রিকভাবে রাজস্ব খাতে এর প্রভাব পড়বে। এমনিতে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আদায় কম। এই সমস্যার কারণে সেটি আরও কমবে।

জানা গেছে, একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য চীনের সঙ্গে। বিদায়ী ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য প্রায় ১৪ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ৮৩১ মিলিয়ন ডলার।

পোশাক খাতে বিশেষ করে ওভেন খাতের কাঁচামালের জোগানের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ এবং নিট খাতে ১৫-২০ শতাংশের উৎস চীন। এছাড়া অন্যান্য অনেক শিল্প খাতের প্রধান কাঁচামালের উৎস চীন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে দেশটির সঙ্গে টানা এক মাস অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রায় স্থবির ছিল।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট এটিএম আজিজুল আকিল সোমবার  বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা হতাশ। চীনের ব্যবসায়ীরা আমাদের বলছে সমস্যা কেটে যাবে। কিন্তু তাদের কারখানা চালু হচ্ছে না। কিছু কিছু কারখানা খুলেছে, কিন্তু দূরের শ্রমিকরা কাজে আসছে না।

ফলে উৎপাদন বন্ধ। তিনি বলেন, চীনের পর কোরিয়ায় ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। আর এ অবস্থা ১০ মার্চ ছাড়িয়ে গেলে দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, মূল সমস্যা হচ্ছে শিল্পের কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না।

এছাড়াও নতুন বিনিয়োগের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আসছে না। তার মতে, সমস্যা শুধু চীনের কোম্পানির নয়, সারা বিশ্বের ব্রান্ডের সবগুলো কোম্পানির মূল কারখানা চীনে। ফলে ইউরোপের কোম্পানিগুলো সে দেশে অর্ডার নিলেও পণ্য সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থা কাটারও লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আবদুল কাদের খান বলেন, আমাদের শিল্পের কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু টানা প্রায় দেড় মাস বন্ধের কারণে কাঁচামাল প্রায় শেষ।

দুই-একজন বলছেন, নতুন এলসি (ঋণপত্র) খোলা শুরু হয়েছে। কিন্তু হাতে কাগজ না পেলে কিছুই বলা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত। সরকারকেও জানানো হয়েছে। তার মতে, সমস্যার সমাধানে বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে।

এদিকে করোনায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সেখানে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, করোনার প্রভাবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে স্থবির। এর আগে যে সব এলসি খোলা ছিল, সেগুলোর জাহাজীকরণ ও ডকুমেন্টস পাওয়ায় জটিলতা দেখা দিয়েছে।

নতুন ঋণপত্র খোলাও কমে যাচ্ছে। অর্থনীতির ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ৮০ শতাংশের মতো প্রায় এক মাস স্থগিত ছিল। চীনের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল ২৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে শিপমেন্ট শুরু হবে। তারা বলেন, চীন বাংলাদেশের ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘদিনের অন্যতম অংশীদার।

রফতানি পণ্যের কাঁচামালসহ মধ্যবর্তী কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশসহ তৈরি পণ্য যেমন ইলেকট্রনিক মটর, সিনথেটিক ইয়ার্ন ইত্যাদি সিংহভাগই চীন থেকে আমদানি হয়। বস্ত্র ও তৈরি পোশাকসহ সব ম্যানুফ্যাকচারিং খাত- চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক, ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, ফুটওয়্যার, কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিস, মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্টস, কম্পিউটার, ওয়াটার পাম্প, মটর ছাড়াও পরিবহন ও যোগাযোগসহ সব খাতে স্বাভাবিক সরবরাহে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এ বছর জানুয়ারি মাসে ৬ দশমিক ৭২ লাখ টন পণ্য এসেছে।

অথচ ২০১৯ সালে এ পণ্যের পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৫১ লাখ টন এবং ২০১৮ সালে ৮ দশমিক ৯২ লাখ টন। ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, যেহেতু পণ্যের সরবরাহ এক মাসের মতো বিঘ্ন ঘটেছে, ব্যাংকে খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য ঋণ সহায়তার বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যথাযথ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যাংকে সরবরাহ করলে তাদের অ্যাকাউন্ট যাতে কোনোভাবে খেলাপি না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কাজ করছে এশিয়ান টাইগার পার্টনার্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতি ইসলাম সোমবার  বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে মূলত চার খাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথমত, বাংলাদেশের আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তৃতীয়ত, চীন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারা বিশ্বে এর প্রভাব পড়বে। এতে যে সব দেশ বাংলাদেশ থেকে পণ্য নেয়, তাদের চাহিদাও কমবে। চতুর্থত, বাংলাদেশের বড় প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।