করোনাকালে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সুরক্ষা

পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রতিনিয়ত বসতবাড়ি থেকে শুরু করে চারপাশ পরিষ্কার রেখে তাঁরা পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন ও বাসযোগ্য রাখছেন। কিন্তু তাঁদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তায় যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। করোনাভাইরাস মহামারিতে এই বিষয়টি মারাত্মকভাবে সামনে এসেছে।

সম্প্রতি ওয়াটার এইডের একটি জরিপে উঠে এসেছে যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মধ্যে ৩.২৫ শতাংশ কভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব কর্মীর বেশির ভাগই হাসপাতাল বর্জ্য পরিচ্ছন্নতা ও ব্যবস্থাপনায় কাজ করছেন। বাকিদের মধ্যে এই সচেতনতার ব্যাপক অভাব রয়েছে। ফলাফলে আরো দেখা যায়, ৭০ শতাংশ কর্মী সারা দিনের কাজ শেষ করে একবারে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে থাকেন এবং প্রায় অর্ধেক (৪৭.৯৮) পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটেশনকর্মী সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অথচ পরিচ্ছন্নতা কাজের সময় সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার এবং ঘন ঘন হাত ধোয়া করোনা মোকাবেলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারে অনীহা এবং ঘন ঘন হাত না ধোয়ার কারণে তাঁরা প্রতিদিনই কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।

বাংলাদেশে বেশির ভাগ কভিড-১৯ রোগীকেই (মাইল্ড কেস) বাসা থেকে চিকিত্সা নিতে উত্সাহ দেওয়া হয়ে থাকে। ধারণা করা হয়, দেশের মোট করোনা রোগীর ৮০ শতাংশই বাসা থেকে চিকিত্সা নিচ্ছেন। অন্যদিকে আক্রান্ত রোগীদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব রোগীর সৃষ্ট বর্জ্য বাকি বর্জ্যের সঙ্গে মিলে সাধারণত একই ডাস্টবিনে যাচ্ছে, যা একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকেই পরিষ্কার করতে হচ্ছে। এর ফলে প্রতিনিয়ত বর্জ্য ও স্যানিটেশন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসতে হচ্ছে, যা তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। গবেষণায়ও এ বিষয়টিও উঠে এসেছে।

ওয়াটার এইডের জরিপে দেখা যায়, স্যানিটেশন ওয়ার্কাররা সাধারণ মানুষের তুলনায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। বাড়তি ঝুঁকি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে যেমন হুমকির মুখে ফেলছে, তেমনি তাঁদের আর্থিক ও চিকিত্সা নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইক্যান ট্রাস্টের জরিপে উঠে এসেছে যে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মাসিক গড় আয় পাঁচ-সাত হাজার টাকা।

অন্যদিকে প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের একটি জরিপে দেখা গেছে, মহামারির কারণে ৪১ শতাংশ পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বেতন কমেছে। দিনে তিন  বেলা পর্যাপ্ত খাবার জোটে না ৭৯ শতাংশ পরিবারের। আয়ের এমন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাঁরা মাস্ক ও গ্লাভস কিনে কাজ করে যাচ্ছেন। ওয়াটার এইডের জরিপ মতে, ৭০ শতাংশ পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে নিজের আয়ের টাকা থেকে সুরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করতে হয়েছে। যদিও করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর সময় থেকেই বলা হয়েছে, যেসব মানুষ প্রতিদিন অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসেন, তাঁদেরকে সুরক্ষা দিতে হবে আগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রদান করতে হবে। কিন্তু নগরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অনেককেই সুরক্ষাহীনভাবে কাজ করতে দেখা গেছে। এর পেছনে সুরক্ষা সরঞ্জামের সরবরাহ অপ্রতুলতাকে দায়ী করা হয়ে থাকে।

মে মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ১৫ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে একজন মারা গেছেন।  এরপর পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য উপাত্ত পাওয়া যায়নি, তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মীই বিভিন্ন সময়ে করোনা রোগের উপসর্গে ভুগেছেন।

প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের জরিপে দেখা গেছে, ৩৯ শতাংশ পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মধ্যে করোনা উপসর্গ দেখা দিয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৪৬  শতাংশ কোনো রেজিস্টার্ড চিকিত্সকের পরামর্শ নেননি। চিকিত্সকের পরামর্শ না নেওয়ার বিষয়টির সঙ্গে চিকিত্সা বিষয়ক তথ্য না জানার সম্পর্ক থাকতে পারে। ওয়াটার এইডের জরিপে উঠে আসে যে ৩৭.৪ শতাংশ স্যানিটেশন ওয়ার্কারদেরই জানা নেই যে উপসর্গ দেখা দিলে টেস্ট কোথায় করতে হবে এবং টেস্টের ফলাফল পজিটিভ হলে চিকিত্সার সঠিক পদ্ধতি কী হবে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বর্জ্য ও স্যানিটেশন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের উপসর্গ মারাত্মক আকার ধারণ করেনি বলে তাঁদের সুরক্ষার বিষয়টিকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এই ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনো অজানা। আক্রান্তের শ্বাসতন্ত্রে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত থেকে গেলে এসব মানুষ পরবর্তী সময়ে ছোট অসুখে বড় পরিণতির মুখোমুখি হতে পারেন। তাই এই জনগোষ্ঠীর জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে। তাঁদের সুরক্ষা ব্যবস্থায় সরবরাহ করতে হবে সুরক্ষা সরঞ্জাম (মাস্ক, গ্লাভস, গগলস, পিপিই, গাউন, বুটস)। সেই সঙ্গে কাজের সময় সব সুরক্ষা উপকরণ একসঙ্গে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অন্যথা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা অসুস্থ হতে শুরু করলে মানবিক বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা ও জনস্বাস্থ্যেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে বলে আমরা মনে করি।

আইক্যান ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় প্রতিদিন চার হাজার ৫০০ টন আবর্জনা তৈরি হয়। এই আবর্জনা পরিচ্ছন্নতায় কাজ করেন ২১ হাজার ক্লিনার ও ওয়েস্ট হ্যান্ডেলার। এই বিপুল পরিমাণ মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে, সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সম্মিলিতভাবে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে অ্যাকশন পয়েন্টস তৈরি করতে হবে। যাতে কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং স্যানিটেশন ওয়ার্কাররা বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা, বীমা এবং সুবিধা পায়।

বর্তমানে প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে এটা বোঝা যায় যে করোনা দীর্ঘ সময় ধরে থাকবে। তাই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাঁরা গ্লাভস, মাস্ক, গাউন—সবগুলো একসঙ্গে পরেন। কারণ একটিও বাদ থাকলে সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

পৌরসভার কর্মীদের প্রশিক্ষণে ডিপিএইচের একটি গাইডলাইন রয়েছে, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটি আপডেট করতে হবে।

বাসাবাড়িতে ব্যবহূত সুরক্ষা সরঞ্জাম আলাদা করে ফেলতে হবে, যাতে কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে সরাসরি ভাইরাসের সংস্পর্শে না আসতে হয়।

প্রতিটি ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের নিচে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী বর্জ্য সংগ্রহ করার আগে ও পরে যাতে হাত ধোয় সেটি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তাকর্মীকে নির্দেশনা দিতে হবে।

পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সমাজে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। সুরক্ষা পরিকল্পনা থেকে তাঁদের বাদ দিয়ে আমরা কভিড-১৯ মোকাবেলায় কার্যকর সাফল্য পাওয়ার আশা করতে পারি না। তাই প্রাপ্য মর্যাদা ও প্রণোদনা দিয়ে তাঁদের সুরক্ষায় একসঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটার এইড- বাংলাদেশ