কতটা মুক্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যম?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এমন দিনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক আলোচনা হবে,  এটাই স্বভাবিক। কিন্তু আলোচনা- সমালোচনায় কতটা সাহসী হতে পারবে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ?  কতটা মুখ খুলে বলতে বা হাত খুলে লিখতে পারবে তারা ?  আর এসবই হয়তো বলে দিবে কতটা মুক্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যম। তবে ভুললে চলবে না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিন্তু গণমাধ্যম নয় ,  যেখানে আবার ‘অনেকটাই মুক্ত’ থাকেন সাংবাদিকরা! তবে এমন অনেক স্ট্যাটাসও আমি সাংবাদিকদের দিতে দেখেছি যে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমার দেওয়া পোস্টটি মুছে দিলাম। ‘ফিলিং পেইন’।

মার্কিন লেখক ওয়ার্ড চার্চিলের একটা কথা মনে পড়ল। তিনি একবার বলেছেন, ‘আমেরিকার মানুষ স্বাধীন, তবে ততটুকুই, যতটুকু দেওয়া হয়।’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। বিশেষ করে ,  আমাদের গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে। আমাদের ‘গণমাধ্যম স্বাধীন, তবে ততটাই যতটা দেওয়া হয়’। কিন্ত কার  হাতে এই ক্ষমতা ?  কে নির্ধারণ করে এই তালগাছ ?  এটা বুঝতে বিশাল গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার আছে কি?

গণমাধ্যমর ওপর চাপ বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। দুনিয়াজুড়েই এই চাপ আছে। স্বাধীনতার পর থেকে নানা চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে গণমাধ্যমকে। কখনো গণতান্ত্রিক শাসকদের কবলে পড়েছে,  আবার কখনো সামরিক শাসক। আর সঙ্গে মালিকানা ও বিজ্ঞাপনের চাপ তো বরাবরের। এই নানামুখী চাপের সঙ্গে সাংবাদিকদের দলীয় লেজুরবৃত্তি ও সুবিধাগ্রহণ কখনো বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে পেশাদার হতে দেয়নি। আর এই অপেশাদারত্ব দিন দিন খোদ সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাটিকে বিতর্কিত করছে, নষ্ট করছে।

সরকার-মালিক-বিজ্ঞাপন : ত্রিশুলে বিদ্ধ গণমাধ্যম
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোচনায় এই তিন পক্ষই আসলে মিলেমিশে একাকার। আমরা চাইলে এই গাঁট ছিড়তে পারব না। যেমন পারছে না গণমাধ্যম। আমাদের দেশে সরকারি চাপ আসে বিভিন্ন জায়গা থেকে। সরকারের মন্ত্রী, আমলা, বিভিন্ন বাহিনী এবং সরকারি দলের নেতা কর্মীরা তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে সাংবাদিকদের ওপর এমন চাপ তৈরি করে যে, অনেক সংবাদই তাদের শেষ পর্যন্ত চেপে যেতে হয়। চাপ সামলে যা একটু আধটু আসে, তার ওপর আবার নামে আইনি খড়গ। হালে যোগ হওয়া নতুন আতঙ্কের নাম ৫৭ ধারা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের এই ধারায় সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনা আশংকাজনক হারে বাড়ছে।

সাংবাদিক প্রবীর শিকদার, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও একুশে টেলিভিশনের সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদা, দৈনিক শিক্ষা অনলাইন পোর্টালের এডিটর ইন চিফ সিদ্দিকুর রহমান, বাংলা মেইলের তিন সাংবাদিক মাকসুদুল আলম, শাহদৎ উল্লাহ খান ও প্রান্ত পলাশ এবং সবশেষ নতুন সময় ডটকমের সাংবাদিক রাজু আহমেদ, সবাই শিকার হয়েছে ৫৭ ধারার।

এসব মামলার অভিযোগগুলো দেখুন।  আশুলিয়ায় পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে ‘মিথ্যা সংবাদ ’ প্রকাশ, মন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, একজন সরকারি কর্মকর্তা বা আমলার মানহানি এবং সর্বশেষ একটি প্রাইভেট কম্পানির বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করা। আর অভিযোগকারীরা হলেন পুলিশ, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ধারণা করছি,  ক্ষমতাসীনদের ৫৭ ধারা চর্চা আন্দাজ করতে পারছেন।

৫৭ ধারা বাইরেও নানা ধরনের মামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রবীণ সাংবাদিকসহ অনেকেই সংবাদ প্রকাশসহ বিভিন্ন কারণে মামলার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে, মাহফুজ আনামের ঘটনায় সরকার সমর্থকরা মামলার উৎসব করেছেন। সত্য চেপে যাওয়াই যে দেশে সে দেশে সত্য স্বীকার করে তিনি ৮৩টি মামলার খড়গ নিয়ে সাংবাদিকতা করছেন।

এর বাইরেও, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানাচ্ছে, ২০১৬ সালে সারা দেশে নির্যাতন, হয়রানি, হত্যার হুমকি, সন্ত্রাসী হামলা প্রভৃতির শিকার হয়েছেন ১১৭ জন সাংবাদিক। এ ছাড়া আমরা দেখি, এ বছরে দোসরা ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের খবর সংগ্রহের সময় গুলিতে নিহত হয়েছেন সমকালের সাংবাদিক আবদুল হাকিম। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক প্রতিবেদনেব দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই ১৬ বছরে ২৮ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দুই ৭৬১ জন।

এ ছাড়া নানা ভাবে গণমাধ্যমের কন্টেন্ট বা আধেয় বা অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। অভিযোগ আছে, টকশোর আলোচক কে হতে পারবেন বা পারবেন না, সেটাও মাঝেমাঝে (বিশেষ সময়ে) নিয়ন্ত্রণ করে সরকার ও তার বিভিন্ন এজেন্সি।

গণমাধ্যমকে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হচ্ছে না, সাংবাদিকদের উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো হুমকি দিচ্ছে, দুর্নীতবাজদের বিরুদ্ধে লিখলে তারা ক্ষমতা প্রদর্শন করছে। চাপমুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারছে না দেশের গণমাধ্যম। ’ তাই এই সাংবাদিকের মতোই, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম নিজেরাই নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে।

এত গেল সরকারি চোখরাঙানি। নিয়ন্ত্রণ কৌশল। এর সাথে আছে মালিকদের চাওয়া-পাওয়া। তার বাইরে যায়, এমন বুকের পাটা কার? তাই নিয়মিতভাবেই ‘আপস সাংবাদিকতা’ করতে হচ্ছে এ দেশের সব গণমাধ্যমকেই। এটাকেই অনেকে বলেন করপোরেট সাংবাদিকতা।

ইদানীং আমরা প্রায় দেখি, বিভিন্ন করপোরেট গ্রুপ স্রেফ তার পণ্যের বিজ্ঞাপন আর প্রসারের জন্যই নিজের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ব্যবহার করেন। হালে আহমেদ রাজু নামের যে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে, তার সম্পাদিত অনলাইনের খবর আমি দেখেছি। তাতে সাংবাদিকতার মানদণ্ড একদম মানা হয়নি।

এখন আমি জানি না, এই সংবাদ ছাপানোর ক্ষেত্রে এই অনলাইনের মালিকপক্ষ ও ম্যানেজমেন্টের কোনো চাপ ছিল কি না? অসম্ভব কিছু নয়।

কিন্তু এ সত্যটাও আমাদের মানতে হবে যে, যে কোম্পানি তাদের ব্র্যান্ড ইমেজ নষ্ট করার জন্য মামলা করেছে, তারা কি পণ্যের মান ঠিক রাখতে পারছে? আমরা তো হর-হামেশাই দেখি, বিজ্ঞাপনে কত সুন্দর করে মিথ্যা বলা হয়। বিউটি প্রোডাক্ট থেকে শুরু করে খাবার-দাবার, সব পণ্যের বিজ্ঞাপনই তো মিথ্যা থাকে কম বেশি। মিথ্যাকে তো বিজ্ঞাপন নির্মাতারা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এ সত্য কে না জানে ?  কই সেই মিথ্যা নিয়ে তো কোনো মামলা হয় না? কারণ এই মিথ্যা বিজ্ঞাপনের ওপরই অনেকাংশে নির্ভরশীল গণমাধ্যমের বাণিজ্য।

পরাধীন গণমাধ্যম বনাম স্বাধীন সাংবাদিক
নোয়ান চমস্কি ও এডওয়ার্ড হারম্যান গণমাধ্যম নিয়ে তাদের এক আলোচনায় লিখেছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানই স্বাধীন নয়, বড়জোর সেখানকার কিছু মানুষ স্বাধীনচেতা হতে পারে। এই বক্তব্য মেনেই বলছি, সরকার, করপোরেশন, বিজ্ঞাপন, অডিয়েন্স- এই নানামুখী সমীকরণ মিলিয়ে গণমাধ্যমকেও শেষ পর্যন্ত মুনফা করতে হয়। তাকে টিকে থাকতে হয়। তাই, এই টিকে থাকার লড়াইয়ে, গণমাধ্যম কতটা আপস করবে বা কতটা স্বাধীন থাকবে- তা তার ওপর নির্ভর করে না।

একজন সাংবাদিক তার জায়গা থেকে স্বাধীনচেতা হতে পারে। বিভিন্ন ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বক্তব্য দেখলে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। যদিও, সেখানেও তার হাত পুরোপুরি খোলা নয়। কিন্তু এই স্বাধীনচেতা সাংবাদিক গণমাধ্যমে পুরোপুরি মালিকপক্ষ ও তাদের নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এই জাল সহজে ছেঁড়ার নয়।

সবশেষে বলি, গণমাধ্যম আসলে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করবে, সাংবাদিকরা কতটা মুক্তভাবে তাদের কলম চালাতে পারবে বা কথা বলতে পারবে, সেটা  শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর। দেশ যত গণতান্ত্রিক হবে, গণমাধ্যমও তত স্বাধীন হবে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ। 

সূত্র: এনটিভি