‘ঐক্যবদ্ধ থেকে বিশ্বকেও যোগ করে নেবো আমাদের সঙ্গে’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: আবহাওয়া অধিদফতর থেকে পাঠানো ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস মিথ্যে করে দিয়ে সকালের সূর্যটা কী দারুণ মিষ্টি হেসেছে! নতুন সে আলোয় যেন সকল জরাকে জানিয়েছে বিদায়। জীর্ণ-পুরনো, অশুভ ও অসুন্দর সবকিছুকে পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে আবারও এলো পহেলা বৈশাখ। বঙ্গাব্দ ১৪২৫। আজ (শনিবার) বৈশাখকে বরণ করতে সেজেছে সারাদেশ। আর সেই আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ছায়ানট আয়োজিত রমনার বটমূলে প্রধান বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। এতে ছায়ানট-এর সভাপতি সন্‌জীদা খাতুন তুলে ধরেন বিশ্বায়নের বাস্তবতা ও শেকড় সন্ধানের বিষয়। তিনি বলেন, ‘পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থেকে বিশ্বকেও যোগ করে নেবো আমাদের সঙ্গে। দেশীয় মানসের সঙ্গে বিশ্ব মানসের সহজ সংযোগেই আসবে মানবকল্যাণ।’

এর আগে শনিবার (১৪ এপ্রিল) ভোর ঠিক সোয়া ছটায় রমনা বটমূলে শুরু হয় বর্ষবরণের এই ঐতিহ্যবাহী আনুষ্ঠানিকতা। বাঁশিতে ভোরের রাগালাপ দিয়ে সূচনা হলো বর্ষবরণের ৫১তম এই আয়োজন। এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য- বিশ্বায়নের বাস্তবতায় শিকড়ের সন্ধান।

সমবেত কণ্ঠে জাতীয়সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে এই আয়োজনের সমাপ্তি টানার আগে বর্ষবরণ প্রসঙ্গে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে সন্‌জীদা খাতুন বলেন, ‘বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস, পাহাড়-সমতল-প্রান্তর, নদী-সমুদ্র, বৃক্ষ-লতা, ফুল-ফল, পাখপাখালি আমাদের পরম প্রিয়। প্রিয় এদেশের সব মানুষ।’ আরও বলেন, ‘যে মাটি আমাদের পায়ের তলায় আশ্রয়, জন্মের শুভক্ষণে সেই মাটিতেই ভূমিষ্ঠ হয়েছি আমরা।  জন্মসূত্রে এ মাটি আমাদের একান্ত আপন। সে মাটির বুকে শিকড়ের মতো পা ডুবিয়ে মাটি-মাতাকে জানবো আমরা।’

বিশ্বায়নের প্রসঙ্গ তুলে ছায়ানট সভাপতি বলেন, ‘শিকড়ের মাটিতে দৃঢ়বদ্ধ থেকে বিশ্বায়নের ফলে পাওয়া সত্য-সুন্দরকে আত্মগত করে ঋদ্ধ হবো আমরা। ‘বিশ্বায়ন’ আজ আমাদের কাছে বাস্তব সত্য। এ শব্দ নিন্দা অর্থে উচ্চারণ করছি না। বিশ্বের সংগীতে-সাহিত্যে, শিল্পকলায়-দর্শনে-বিজ্ঞানে যে মহান অর্জন তার স্বাদ নেবো আমরা। আত্মস্থ করতে হবে সব মানবিক সম্পদ। সেই সত্য সুন্দর সমৃদ্ধ করবে আমাদের।’

এদিকে শনিবার  ‍সূর্যোদয়ের আগে থেকে এই বটমূলকে ঘিরে জড়ো হতে থাকলো অগুনতি সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষ। সূর্য ফোটার আভা ধরে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা বুঝি শহরের প্রতিটি কোণা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল, ক্রমশ জড়ো হতে থাকলো রমনার বটমূলে; সুরে সুরে বঙ্গাব্দ- ১৪২৫ সালকে বরণ করে নিতে।

দেড়শতাধিক শিল্পীর অংশগ্রহণে দুই ঘণ্টার এই আয়োজন সাজানো হয়েছে ১৬টি একক, ১২টি  গান ও ২টি আবৃত্তি দিয়ে।

বাঁশিতে ভোরের রাগালাপ দিয়ে অনুষ্ঠান সূচনার পর সম্মেলক কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীরা একে একে পরিবেশন করেন, ‘পূর্ব গগনভাগে দীপ্ত হইলো সুপ্রভাত’, ‘ওই পোহাইলো তিমিররাতি’ শিরোনামের গান দু’টি। এরপর তিনটি একক গান—‘শুভ্র প্রভাতে পূর্ব গগনে’,  ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি’ ও ‘জাগো অরুণ ভৈরব’।

এরপর পর্যায়ক্রমে পরিবেশন হয়—‘শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির-নির্মল’ (সম্মেলক), ‘প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে’ (একক),  ‘তোমার হাতের রাখিখানি’ (একক), ‘প্রভাত বীণা তব বাজে’ (ছোটদের সম্মেলক), ‘আজি গাও মহাগীত’ (একক), ‘গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ঐ’ (একক), ‘আজি নূতন রতনে’ (ছোটদের সম্মেলক), ‘জল বলে চল’ (একক), শামীমা নাজনীনের কণ্ঠে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ‘পৃথিবীজোড়া গান’,  রবীন্দ্রসংগীত ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’ (সম্মেলক), ‘মালা হতে খসে পড়া’ (একক), ‘তোমার দ্বারে কেন আসি’ (একক), ‘মেঘ-বিহীন খর বৈশাখে’ (সম্মেলক), ‘এলো এলো রে বৈশাখী ঝড়’ (সম্মেলক)।

এরপর তিনটি একক গান—‘শ্যামলা-বরণ বাংলা মায়ের’, ‘ধুলি-পিঙ্গল জটাজুট মেলে’ এবং ‘ও আমার বাংলাদেশের মাটি’। ছোটদের কণ্ঠে সম্মেলক গান—‘বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে’ এবং বড়দের কণ্ঠে ‌‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন’। একক পরিবেশনা ‘শিরনি খাওয়ার লোভ যার আছে’, বড়দের সম্মেলক গান ‘ও আমার দরদী আগে জানলে’, একক গান ‘জীবন আমার ধন্য যে হায়’ পরিবেশনার পর হাসান আরিফ আবৃত্তি করে শোনান হুমায়ুন আজাদের কবিতা ‌‌‘শুভেচ্ছা’। এরপর ছোট ও বড়দের সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন হয়—‘ওরে আইলো বৈশাখ নয়া সাজে’ গানটি।

সন্‌জীদা খাতুনের বক্তব্য শেষে সমবেত কণ্ঠে জাতীয়সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ছায়ানট আয়োজিত বঙ্গাব্দ ১৪২৫ বরণ উৎসব।

বরাবরের মতো এবারের আয়েজনটিও সরাসরি সম্প্রচার করেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

ছায়ানটের শিল্পী-কর্মীদের জন্য বটমূল সংলগ্ন সামান্য জায়গা ছাড়া গোটা প্রাঙ্গণই উন্মুক্ত ছিল সবার জন্য। বটমূলের বর্ষবরণ আয়োজন সুষ্ঠু রাখতে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

প্রসঙ্গত, পাকিস্তানি আমলের বৈরী পরিবেশে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে ছায়ানটের যে যাত্রার সূচনা, তা মূলত বাঙালির আপনসত্তাকে জাগিয়ে তোলার, আপন সংস্কৃতিতে বাঁচার অধিকার ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার জন্য। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটানোর জন্য ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে শুরু হয় বাংলা নববর্ষকে আবাহনের আয়োজন।

‘কায়মনে বাঙালি’ হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে সেই থেকে পাঁচ দশক ধরে বাংলা বছরের প্রথম লগ্ন পহেলা বৈশাখের প্রত্যূষে মানুষের ভালোবাসাধন্য এই সংগঠন আপন সংস্কৃতির অনুষ্ঠান করে আসছে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রমনার বটমূল, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাংলা নববর্ষ আজ বিশ্বময় বাঙালির সবচেয়ে বড় মিলনমেলা, একটি জাতীয় উৎসব। এই উৎসব আপামর বাঙালিকে প্রাণিত করে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে।

 

 

বাংলাট্রিবিউন