এলএসডি খেয়ে নিজের গলা দা দিয়ে কেটে ফেলেন হাফিজুর!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে লাইসার্জিক এসিড ডাই-ইথাইলামাইড বা এলএসডি নামের এক ধরনের মাদক জব্দ করেছে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। গত বুধবার রাতে রাজধানীর ধানমণ্ডি ও লালমাটিয়া এলাকা থেকে হাফিজের বন্ধুসহ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে এলএসডির ২০০টি ব্লট (মেশানো কাগজ) উদ্ধার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃত তিন তরুণ হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র সাদমান সাকিব ওরফে রুপল ও আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তুর্য এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফ।

ডিবি জানিয়েছে, চক্রটি ফেসবুকে ‘বেটার ব্রাওরি অ্যান্ড বেয়ন্ড’ ও ‘আপনার আব্বা’ নামে গ্রুপ তৈরি করে গাঁজা পাতার নির্যাস মেশানো কেক এবং এলএসডি বিক্রি করছিল। এই গ্রুপে এক হাজারের বেশি সদস্য আছে। টেলিগ্রাম অ্যাপে গোপন যোগাযোগ করে পার্সেলে নেদারল্যান্ডস থেকে এলএসডি সংগ্রহ করে চক্রটি।

ডিবির ভাষ্য মতে, ভয়ংকর মাদক এলএসডি সেবনে বিভ্রম (হ্যালুসিনেশন) হয়। প্রচণ্ড উত্তেজনার সঙ্গে এই মাদক চিন্তা, অনুভূতি ও পারিপার্শ্বিক চেতনাকে পরিবর্তন করে দেয়। এই মাদক সেবন করেই শিক্ষার্থী হাফিজুর আত্মঘাতী হয়েছেন বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের।

দেশে প্রথমবারের মতো এলএসডি উদ্ধার হয়েছে বলে ডিবি দাবি করলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯ সালেও দেশে পাঁচ গ্রাম এলএসডি জব্দ করা হয়েছে। বেশি দামি এই মাদকের প্রচলন ইউরোপ-আমেরিকায় থাকলেও আগে দেশে দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে এই কারবার শুরু হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, সাদমান সাকিব রুপল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর বহিষ্কৃত ছাত্র। বর্তমানে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএতে (শেষ বর্ষ) পড়াশোনা করছেন। তিনিই মূলত বছরখানেক আগে টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে এই মাদক অর্ডার করেন। মাদকের জন্য তাঁরা পে-পালে টাকা পরিশোধ করলে পার্সেলের মাধ্যমে এই মাদক আসে। প্রতিটি ব্লট তাঁরা আট শ থেকে এক হাজার টাকায় কিনেছিলেন। তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। আপনার আব্বা নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সাদমানসহ তাঁরা তিন বন্ধু সেখান থেকে এলএসডি বিক্রি করতেন। বেটার ব্রাওরি অ্যান্ড বেয়ন্ড নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সেখানে গাঁজা পাতার নির্যাস দিয়ে কেক বানিয়ে মাদক হিসেবে বিক্রি করতেন।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আরো বলেন, উদ্ধার করা এলএসডিগুলো দেখতে ডাকটিকিট বা স্ট্যাম্পের মতো। এগুলো যে মাদক তা দেখে বোঝার উপায় নেই। এলএসডি সেবকরা ঠোঁটের নিচে এলএসডি রেখে দিত। এলএসডি নতুন, ব্যয়বহুল ও অতিরিক্ত ক্ষতিকারক মাদক।

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও এলএসডির ইতিহাস ঘেঁটে ডিবি জানায়, এটি ব্যবহার করলে যে কারো মাথা ভার হয়ে যাবে। বিভ্রম তৈরি হবে। কেউ যদি গান শোনে, তার সামনে গানের মিউজিকগুলো বিভিন্ন রঙের মতো ঘুরতে থাকে। সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে।

ডিবির কর্মকর্তা বলেন, এটি সেবন করে সেবনকারী নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবে। সেবনকারী চিন্তা করে, সে উড়তেও পারবে। তার অতীত স্মৃতি চলে আসে। অনেকে বলেছে, এটি সেবনের পর তারা মনে করত যে তারা ট্রেনেও ধাক্কা দিতে পারবে। তিনি বলেন, যারা নেদারল্যান্ডস থেকে মাদকটি বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, তাদের শনাক্তের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে এনসিবি বিভাগে (ইন্টারপোল ডেস্ক) চিঠি দিয়ে খোঁজ নিতে বলা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের ছাত্র হাফিজুর রহমান ছিলেন একজন মূকাভিনয়শিল্পী। টিএসসিভিত্তিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, হাফিজের বন্ধুরা বলেছেন, হাফিজ একটি নতুন ও অদ্ভুত মাদকে আসক্ত ছিলেন। ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীরাও হাফিজের মাতালের মতো আচরণের তথ্য দেয়। এতে সন্দেহ হয় তদন্তকারীদের। এর পরই এলএসডির বিষয়ে তথ্য পেয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ বলেন, ‘আমরা আত্মহত্যা করা হাফিজুরের মরদেহের ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর বলতে পারব, তিনি এলএসডিতে আসক্ত ছিলেন কি না।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার খাড়েরা গ্রামের ইমাম মুজিবুর রহমানের ছেলে হাফিজুর ১৫ মে রাত পৌনে ৮টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা নিজেই কেটে ফেলেন। তখন হাফিজুর মারা গেলেও তাঁর পরিচয় শনাক্ত হয়নি। ঘটনার আট দিন পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তাঁর লাশ শনাক্ত করে পরিবার।

জিজ্ঞাসাবাদে হাফিজুরের বন্ধুদের দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, হাফিজুর ঈদের পরদিন ঢাকায় ফেরার পর সন্ধ্যায় এক প্রতিবন্ধী রিকশাচালকের সঙ্গে বাজে আচরণ করেছিলেন। এরপর তাঁরা কার্জন হল এলাকায় নেশা করতে বসেন। এর পরই হাফিজুর ঢাকা মেডিক্যালের সামনে ডাবওয়ালার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেন।

ডিবি কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তারকৃত তিনজনকে গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে সোপর্দ করে সাত দিন করে রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। শুনানির জন্য আগামী রবিবার দিন ধার্য করেছেন আদালত।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ