এবার সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত বাগমারা, চলছে শক্তির লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাগমারায় নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের মধ্যে অভ্যান্তরীণ কোন্দলের শুরুটা হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বাগমারার তাহেরপুর পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের বিপক্ষে স্থানীয় এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল অবস্থান নেন বলে অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে ওইসময় এমপির অনুসারী এবং পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের অনুসারীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়।

সেই সূত্র ধরে এখন চলছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রীক অভ্যান্তরীণ কোন্দল। এই কোন্দল এতোটাই বড় আকার ধারণ করেছে যে, এমপি এনামুলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে আগামী নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন না দেওয়ারও দাবি জানানো হয়েছে। অপরদিকে এমপির নেতৃত্বে তার গ্রুপের নেতাকর্মীরা উপজেলা সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টুকে দল থেকে বহিস্কারের সুপারিশই করে বসেছেন। এ নিয়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে এমপি এনামুল গ্রুপ এবং সান্টু-কালাম গ্রুপ।

দলীয় সূত্র মতে, গত বছরের মে মাসে বাগমারায় অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন নির্বাচনকে ঘিরে আবারো এমপি গ্রুপ এবং তাহেরপুর পৌর মেয়র কালামসহ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল সান্টু গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে এমপি আরেকদিকে অবস্থান নেন কালাম এবং সান্টু।

বিশেষ করে বাগমারার গোয়ালকান্দি এবং আউচপাড়া ইউনিয়নে প্রার্থী দেওয়াকে কেন্দ্র করে এই দুটি গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এর মধ্যে প্রথমে গোয়ালকান্দি ইউনিয়ন নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়া হয় জেএমবি ক্যাডার আব্দুস সালামকে। এমপি এনামুলের সুপারিশে আব্দুস সালামকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে ওইসময় ব্যাপক হৈ-চৈ শুরু হয় গণমাধ্যমে।

এছাড়া আরও কয়েকটি ইউনিয়নে প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন প্রথম দফায় বাগমারার ১৬টি ইউনিয়নেই নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য হয়। এরপর ওই বছরের মে মাসে গোটা বাগামারায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে গোয়ালকান্দি ইউনিয়নে প্রার্থী পরিবর্তন করে কালাম-সান্টু গ্রুপের প্রার্থী আলমগীরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র আবারো এমপি গ্রুপ এবং কালাম-সান্টু গ্রুপের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত ওই বছরের ৭ মে আউচপাড়া ইউনিয়নে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আওয়ামী লীগের দ্রু’গ্রুপের মোট চারজন নিহত হন। এছাড়াও গোলাকান্দি ইউনিয়নে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মাঝে।

নির্বাচন পরবর্তিতেও বাগমারার বিভিন্নস্থানে এমপি এনামুল গ্রুপ এবং কালাম-সান্টু গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগর্ষের ঘটনা ঘটে। সেই থেকে দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। এরই মধ্যে আগামি সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুনরায় এ দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক দফা মারপিট, হামলা-পাল্টাহামলাসহ পক্ষে-বিপক্ষে মামলার ঘটনাও ঘটে।

এসব মামলায় বাগমারা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল ইসলাম সান্টু, তাহেরপুর পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাহিদুজ্জামান নাহিদসহ অন্ত শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলা হয়েছে এমপির বিপক্ষে অবস্থানকারী নেতাকর্মেিদর নামে। আর এ নিয়েই মূলত বর্তমানে উত্তেজনার পারদ এখন উর্দ্ধমুখি অবস্থানে রয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘোনিয়ে আসছে, দিনকে দিনকে দুই গ্রুপের মাঝে উত্তেজনা আরো বেশি প্রকট আকার ধারণ করছে। এরই মধ্যে এমপি এনামুলকে বাদ দিয়ে বাগমারা আসনে আগামী নির্বাচনে এমপি প্রার্থী হিসেবে জাকিরুল ইসলাম সান্টু অথবা আবুল কালাম আজাদকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে এমপি এনামুলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া নেতাকর্মীরা আগামী নির্বাচনে তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এর পরের দিন ২৭ সেপ্টেম্বর এমপির উপস্থিতিতে বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা থেকে উপজেলা সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল ইসলাম সান্টুকে বহিস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একই সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম সারোয়ার আবুলকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ফের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে দুই গ্রুপের মাঝে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এখন মূলত বাগমারায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে চরমে। এই উত্তেজনা দ্রুত থামাতে না পারলে যে কোনো সময় বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিবে উভয়পক্ষের মধ্যে।

এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই গ্রুপেরই শক্তি প্রর্দশনের জন্য এরই মধ্যে বাগমারায় সর্বহারা ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডারদের মাঝেও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৫ সেপ্টেম্বর বাগমারা পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আইনুল হকের সহযোগী হাবিবুর রহমান হাবিবকে পিস্তলসহ আটক করে পুলিশ। ওইদিন হাবিব তার দলবল নিয়ে পিস্তল নিয়ে ভবানিগঞ্জে আনসার ভিডিপির জেলা অ্যাডজুটেন্ড এবং উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে লাঞ্চিত করেন। এসময় আশরাফ আলী নামের এক এসআইকেও মারপিট করে যুবলীগের ক্যাডাররা।

এসব নিয়ে জানতে চাইলে তাহেরপুর পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজদ বলেন, ‘এমপি একক ক্ষমতা বলে বাগমারা আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে যাচ্ছে। তিনি বিএনপি-জামায়াতের হয়ে কাজ করছেন। জিএমবি এবং সর্বহারা ক্যাডারদের মদদাতা হিসেবে কাজ করে তিনি তার প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। তাই তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে গোটা বাগমারা আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমপির সাথে এখন কোনো প্রকৃত নেতাকর্মী নাই। তিনি নিজেই একক নেতা হয়ে যাচ্ছে-তাই করছেন।’

অন্যদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল ইসলাম সান্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী উপজেলা আওয়ামী লীগ বরখাস্ত করতে পারে না। আর আমি কোনো অন্যায় কিছু করিনি। যা করেছি-তা হলো এমপির অনৈতিক কর্মকা-ের প্রতিবাদ করেছিমাত্র। এতে যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ যা শাস্তি দিবেন, তা মাথা পেতে নিব।’

অন্যদিকে এমপি এনামুল হক বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটি দলীয় ফোরামে আলোচনা করা যেত। কিন্তু সেটি না করে সাধারণ সম্পাদক সান্টু দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের মাঝে উস্কানী ছড়াচ্ছেন। তাই বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগ তাকে বহিস্কারের সুপারিশ করেছে। এ সুপারিশ সর্বসম্মতভাবেই গৃহীত হয়েছে। সান্টুরা সুবিধাবাদি নেতা। তারা জেএমবি-সর্বহারাদের মদদদাতা। তারাই বাগমারায় এখন আবার নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। কিন্তু এটি আর হতে দেওয়া হবে না।’

স/আর