এনসিটিবিতে হচ্ছেটা কী

দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ২০২৩ সালে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে নতুন বই। এই লক্ষ্যে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাইলটিং হবে প্রাথমিক স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির। প্রাথমিকের ১০০ ও মাধ্যমিকের ১০০ বিদ্যালয়ে পাইলটিং হওয়ার কথা; কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে ২০০টিতে নয়, ১০০ থেকে ১২০টিতে পাইলটিং হবে। আমরা এখন যে কারিকুলাম ব্যবহার করছি সেটি ২০১২ সালে প্রণীত হয়েছে। প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির শিক্ষাক্রম নবায়ন করা হচ্ছে। অন্য শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হচ্ছে। পুরোপুরি নবায়ন করা হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম।

কারিকুলাম হচ্ছে শিক্ষার পরিকল্পনা। বলা যায় মহাপরিকল্পনা। এটি যেনতেন কোনো কাজ নয়। এটি শুধু শিক্ষক বদলি, বই ছাপা আর বই বিতরণ নয়। এই বিষয়টি বুঝতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। শিক্ষক হলেই কারিকুলাম তৈরি করতে পারেন না। সরকারি চাকরি করলেই সবাই কারিকুলাম তৈরি করতে পারেন না। দেখা যায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি শিক্ষকদের বদলি করে এনসিটিবিতে পাঠানো হয়। এনসিটিবিতে এসে তাঁরা কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ হয়ে যান। অথচ বদলি হয়েছেন তদবিরের জোরে কিংবা আরো কোনো শক্তিশালী কারণে, যার সঙ্গে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এনসিটিবি কারিকুলামের সঙ্গে জড়িত থাকতে হবে শিক্ষাবিদ, যাঁরা প্রকৃত অর্থে পড়াশোনা করেন, পড়াশোনা জানেন, পড়াশোনা নিয়ে, দেশের শিক্ষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। পদ দেখে, পজিশন দেখে এগুলো নির্বাচিত করা হয় বলে এত দুরবস্থা এনসিটিবির। এনসিটিবিতে যাঁদের বদলি করা হয় তাঁরা সবাই সরকারি কলেজের শিক্ষক। দু-একজন হয়তো সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

২০১২ সালের কারিকুলাম প্রণয়নের পর শিক্ষার আরেকটি প্রকল্প ‘সেসিপের’ মাধ্যমে ২০১৭ সালে এটি রিভিউ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের অর্থ ছাড়ে দেরি হওয়ায় সেই রিভিউ আর হয়নি। এরপর ঠিক হয় ২০১২ সালের কারিকুলাম রিভিউয়ের কাজটি করবে শিক্ষার আরেক প্রকল্প ‘এসইডিপি’। এসইডিপি রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নিলে সেসিপ কাজটি আর করেনি। ২০১৯ সালে এসে এনসিটিবি জানায় এসইডিপি নয়, এনসিটিবি নিজেরাই রিভিউয়ের কাজটি করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, রিভিউ করার জন্য এনসিটিবির কি সেই দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল আছে? কর্মকর্তা যে কয়জন আছেন তাঁরা সবাই টেন্ডার ডাকা, বই ছাপা আর বই বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কারিকুলাম রিভিউ করার মতো কয়জন সেখানে আছেন? বিনা মূল্যে বই বিতরণ করা সরকারের একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই বই কোনো বছরই যে শিক্ষার্থীরা সময়মতো পায় না সেটির খবর আর কে রাখেন? বেসরকারি পর্যায়েই বেশি শিক্ষক, বেশি শিক্ষার্থী। তাদের বিনা মূল্যের এই বই নিতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত, পদে পদে ঘুষ দিতে হচ্ছে, তা কি কর্তাব্যক্তিরা খোঁজ রাখেন?

যেসব প্রতিষ্ঠান তাঁদের বিদেশে ঘোরাতে নিয়ে যেতে পারে বা নেয় এনসিটিবিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা তাঁদের দ্বারা কারিকুলাম লেখা, রিভিউ করা, কারিকুলাম তৈরির কাজগুলো করাচ্ছেন বলে প্রমাণসহ দেশের কয়েকটি পত্রিকা বলে দিয়েছে। এনসিটিবি থেকে বিষয়টি সাফাই দেওয়ার জন্য বারবার বলা হয় যে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা কারিকুলাম তৈরি করান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বললেই হুমড়ি খেয়ে পড়ার কিছু নেই। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর নাকি গবেষণা করছেন কিংবা একটি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছেন। তাঁর কয়েকটি প্রশ্ন আমাকে অবাক করেছে। কয়েকটি এখানে তুলে ধরলাম—ক. বাংলাদেশে কি কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে? ২. বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা তো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, তাই না? ৩. প্রাথমিক শিক্ষকরা কি তাহলে এমপিও পান, ইত্যাদি। দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে যাঁদের পুরো ধারণা নেই, তাঁরা প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে কী গবেষণা করবেন, আর কী প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করবেন, কী সুপারিশ দেবেন—সবই প্রশ্নসাপেক্ষ। যদিও সবাই এমন নন। অনেকেই দেশের পুরোপুরি শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক ভালো জানেন। তাঁদের সংখ্যা অবশ্য খুবই কম।

এনসিটিবি কিছু এনজিওকে সংযুক্ত করেছে কারিকুলাম প্রণয়নের কাজে। বিষয়টি প্রায়ই পত্রিকায় আসছে এমনভাবে যে অনেক এনজিওর কারিকুলাম নিয়ে কোনো ধারণা নেই, তারা কারিকুলামের কী বোঝে? এখানে কয়েকটি বিষয় জড়িত। একটি হচ্ছে, যেসব এনজিও শিক্ষা নিয়ে কাজ করে তারা শিক্ষার খুঁটিনাটি, দেশের, গ্রামের, সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা সরাসরি জানে এবং প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে। তারা সাধারণ মানুষের কাছে, অসহায় মানুষের কাছে ছুটে যেতে পারে। তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে, যা কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী, বিদেশি কোনো কনসালট্যান্টের দ্বারা সম্ভব নয়।

আমি সরকারেও কাজ করেছি, এখন বেসরকারিতে করছি। গ্রামের অসহায় মানুষ, শহরের বস্তিবাসীদের জন্য শিক্ষা কিভাবে নিশ্চিত হতে পারে সেটি সরকারের কোনো সংস্থার পক্ষে প্রকৃতভাবে নির্ণয় করা যে সম্ভব নয়, তা আমি নিজে বহু বছর ধরে প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু অনেকেই স্বীকারও করবেন না, না করারই কথা। তবে এটি সত্য, এ ধরনের কাজ কিন্তু সব এনজিও করে না, করতে পারে না। তাদের যদি দেশের কারিকুলাম তৈরির কাজ দেওয়া হয় সেটি মেনে নেওয়া যায় না। যে দুটি এনজিওর নাম দেখলাম তাদের জাতীয় কারিকুলাম তৈরি করার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা—কোনোটিই নেই। এ ধরনের এনজিওকে যদি কারিকুলাম তৈরির কাজ দেওয়া হয়, তাহলে তো তা মেনে নেওয়া যায় না। এসব এনজিওকে দিয়ে যদি কারিকুলাম তৈরির কাজ করানো হয়, তাহলে কারিকুলামের বারোটা বাজবে।

কারিকুলাম তৈরি ও রিভিউর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে করা উচিত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এনসিটিবি চেয়ারম্যানকে সেভাবেই নিয়োগ দিতে হবে। এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে হতে হবে জাতীয় ব্যক্তিত্ব। জানি এ ধরনের ব্যক্তিত্ব তৈরি করা বা হওয়া এ সমাজে সহজ নয়, কিন্তু করতে হবে। প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও দেশকে এই ধরনের শিক্ষাবিদ তৈরি করতে হবে।

বর্তমানে যেটি হচ্ছে, ইংরেজি কারিকুলাম সমন্বয়ের দায়িত্বে আছেন প্রাণিবিজ্ঞান থেকে পড়াশোনা করে আসা একজন কর্মকর্তা। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রগ্রাম (সেসিপ) কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এসব কর্মকর্তাকে রাখা হয়নি। বাদ দেওয়া হয়েছে কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট উইংকেও। আবার অখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রাখা হয়েছে শিক্ষাক্রম প্রণয়নে। ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা শিক্ষকও রাখা হয়েছে। এটি অবশ্য দোষের কিছু নয়। কারণ ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনা অনেকটাই সৃজনশীল, কাজেই এখানে যাঁরা পড়ান সৃজনশীলতা সম্পর্কে তাঁদের কমবেশি ধারণা থাকে। দেখার বিষয় হচ্ছে, সেই বিবেচনায় কি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নাকি ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদকে একটি চাকরির মতো দেখলে হবে না। এই পদ হতে হবে ১০ থেকে ১২ বছরের, যাতে একটি কারিকুলাম প্রণয়ন করার পর তার পাইলটিং, অ্যাফেক্ট—সবই একজন চেয়ারম্যান দেখে যেতে পারেন। এটি অন্য সব চাকরির মতো নয় যে অনেককেই চেয়ারম্যান হতে হবে, তাই একজনকে তিন-চার বছরের মধ্যেই চেয়ার ছেড়ে যেতে হবে, যাতে তাঁরা সেখানে বসতে পারেন।

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও বাউবির শিক্ষক। প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ