রবিবার , ২১ জুন ২০২০ | ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরীর খবর
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

এক হার না মানা করোনাজয়ী যোদ্ধা

Paris
জুন ২১, ২০২০ ৬:২২ অপরাহ্ণ

গত মাসের এক বিকালে (৪ মে) হঠাৎ সাইয়্যেদা জিন্নাতের ফোন। খুব স্বাভাবিক গলায় তিনি বলেন ” শারমিন, আমার করোনা পজিটিভ। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”

ফোনটা রাখার পরে বাকরুদ্ধ হয়ে কতক্ষণ বসেছিলাম। কারণ ঠিক তার আগের দিনই আমার করোনা রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছিল। এর আগে একজন করনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলাম তাই নিজেকে সম্পূর্ণ কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝে প্রায় ছয় থেকে সাত দিন প্রচণ্ড শরীর ব্যথা। গলাভার এবং অল্প জ্বর নিয়ে রুমে শুয়ে বসে কাটাচ্ছিলাম।

আমার কথা খুব বেশি কেউ জানত না। আমি কখনই চাইনি আমাকে নিয়ে কেউ খুব বেশি প্যারা নিক। কিন্তু ওই সময়ে এই মেয়েটা আমাকে কল দেয় এবং বুঝতে পারে আমি অসুস্থ। বারবার মানা করি যে আমার কিছু লাগবে না। কিন্তু সে রাত বারোটার সময় আমাকে লেবু দিয়ে যাবে। এতটা ডেসপারেট ছিল। দুই মিনিটে সব কথাগুলো আমার মাথায় ঘুরছিল। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু এই মেয়েটি ধৈর্য ধরে, ভয় না পেয়ে চুপচাপ আইসোলেশন এ চলে যায়।

১৫ মে সেহরির পরে এক জুনিয়রের মেসেজ “আপুর কি হয়েছে জানেন?” আমি তো অবাক! হ্যাঁ ও পজেটিভ এবং অমুক হাসপাতালের আইসোলেশনে আছে। তখন ও যা বর্ণনা করলো আমার হুঁশ উড়ে গেল। শ্বাসকষ্ট হওয়ার কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেকবার কল দেয়ার পরে সে মেসেজ দিল- কথা বলতে পারবে না। সে ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ। যেহেতু নিজে চাচ্ছিল না তাই আমি আর বিরক্ত করিনি। কিছু লাগলে আমাকে জানিও মেসেজ দিয়ে চুপ করে ছিলাম।

পরদিন দুপুর বেলা আমাদের কমন ফ্রেন্ড নাসরীন সুলতানা নিপা আমাকে কল দিয়ে বলে “শারমিন তুমি কি জানো ও কুর্মিটোলা আছে?”

এবার আমি ঠিক আকাশ থেকে ধাম করে মাটিতে পরলাম। সঙ্গে সঙ্গে কল দেই কিন্তু তখন সে কথা বলতে পারছিল না। লিটার লিটার অক্সিজেন লাগছিল। রাগ করব তার ওপরে তাও পারছিলাম না।

বললাম- কিছু লাগলে আমাকে বলো। সে কিছুতেই বলবে না যে তার কিছু লাগবে। অনেক অনুরোধ করার পরে সে একটা একটা করে বলা শুরু করল। বিশাল লিস্ট ধরিয়ে দিল। পরের দিন যাব কিন্তু কিসে যাব কিভাবে যাব বুঝতে পারছিলাম না। তাও কুর্মিটোলা!

সঙ্গে সঙ্গে ডা. মুহিবুর রহমান রাফে ভাইয়াকে কল দিই। কারণ আমার সব বিপদের সময় যে মানুষটিকে আমি সবার আগে স্মরণ করি তিনি হলেন আমার বড় ভাই, রাফে ভাই। ভাইয়া বললো, তুমি আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবে এবং আমাদের অ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ে যাবে। আর কোনো কথা বলবে না, কিছু লাগলে সরাসরি আমাকে জানাবে।

১৭ মে। রোজা রেখে রোদ্রের মাঝে স্বপ্নের সামনে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে সব কিছু কিনে অ্যাম্বুলেন্সে করে রওনা দেই। কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্স রেখে জিনিসপত্র নামাচ্ছিলাম। ঘটনার শুরু হয় এখান থেকে।

গেটে যে দারোয়ান বসা ছিল সে আমার ওপরে খ্যাক খ্যাক করে ওঠে। জিনিসপত্র রাখা যাবে না। আমি কই রাখব? আমাকে নামাতে তো হবে? ড্রাইভার উপরে যাবে না। ৫ লিটার পানি, একটা বালতি, তিনটা ব্যাগ হাতে নিয়ে আমি ভিতরে ঢুকি।

সবাই আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিলো মনে হচ্ছিল আমি এলিয়েন। কারণ আমার গায়ে কোনো পিপিই ছিল না। তাড়াহুড়ার জন্য আমার মাথায় ছিল না যে পিপিই নিতে হবে। এক দারোয়ানের ভুলের জন্য আমি চার তলায় গিয়ে ১৫ মিনিট গন্তব্য খুঁজতে থাকি। তারপর আবার ফোন দিয়ে শিওর হয়ে গাট্টি বস্তা নিয়ে লিফটের ৮ চলে যাই। কোনোমতে ছ্যাছড়াতে ছ্যাছড়াতে সবকিছু নিয়ে ভিতরে ঢুকি। ঢুকে দেখি

হাতের বাম পাশে সিস্টারস স্টেশনে পুরো পিপিই পরা, গগলস,মাস্ক পরে তিনজন সিস্টার বসে আছেন। তাদেরকে বললাম যে আমি ডক্টর, অমুকের জন্য জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি, প্লিজ পৌঁছে দিন।

তারা আমাকে বলেন দরজার সামনে রেখে যান উনি এসে নিয়ে যাবেন। কিন্তু আমি রোগীর সঙ্গে কথা বলতে পারছিলাম না, তার এতটাই কষ্ট হচ্ছিল। তাদেরকে বললাম “ওতো বিছানা থেকে উঠতেই পারছে না ওইটা নেবে কিভাবে?”

তারা কোনোভাবেই আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছিল না। আমি বললাম, আমি একজন ডাক্তার। দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।

তারা একবার আমার দিকে তাকিয়ে সুর নরম করে বলেন “আমারা জানি নাহ, আমরা ভেতরে যাই না। রোগী এসে নেয়” বলে নিজেদের খোশগল্পে মগ্ন হয়ে যায়।

আমি আইসোলেশন ওয়ার্ডের দরজার সামনে প্রায় আধা ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাদের কাছে আমি আবার যাই এবং যখন চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করি তখন তারা বলে আপনি এক দৌঁড় দিয়ে চলে আসেন। আমার গায়ে কোন পিপিই নাই।

আমি জানতাম তাদের কাছে নেই তবুও আমি বললাম “আপনাদের কাছে এক্সট্রা কোন পিপিই আছে?” এমনভাবে তাকালো মনে হলো তাদের কলিজাটা আমি চাইছি!

উপায়ন্তর না পেয়ে আমি দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেলাম। ভেতরে ঢুকে আমি যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একটি অন্ধকার রুম, তার মাঝে এক কর্নারে একজন চিকিৎসক যিনি চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে আমাকে দেখে কাঁদছেন। আমার নিজের এতো কান্না পাচ্ছিল কিন্তু আমি চেষ্টা করছিলাম নিজেকে শক্ত রাখার। তার দিকে দৌঁড়ে যাচ্ছিলাম তাকে ধরে ওঠানোর জন্য।

ওই অবস্থায়ও সে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখে। জিনিসগুলো বের করে তাকে বুঝিয়ে দিয়ে আমি বাইরে চলে আসি। হিতাহিত জ্ঞান তখন ছিল না। আমি সিস্টারদের কাছে দৌঁড়ে যাই যে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার একজন কেউ যান। তারা আমার ওপর চিৎকার দিয়ে উঠেন। সরে দাঁড়ান, আরো দূরে সরে দাঁড়ান। আমি আরও দূরে চলে যাই, তাদেরকে কয়েকবার অনুরোধ করি। যদি এখন ওর কোনো সমস্যা হয় তাহলে কি কোনো কিছুই করার নেই? তাদের উত্তর থাকে ” আপনি তো চিকিৎসক? আপনি নিজে জানেন না এটার কোনো চিকিৎসা নেই?”

ততক্ষণে আমার সব শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল। রাগে আমি থরথর করে কাঁপছিলাম। বের হয়ে এসে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। খুব অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে।

হঠাৎ করে মাথা একটি ছেলের নাম আসলো যে সেই প্রথম থেকে জান-প্রাণ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মোবারক হোসাইন। ডক্টরস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সভাপতি। কল দিয়ে বললাম আমি কুর্মিটোলা আছি আমার পরিচিত একজন ভর্তি। ওর জন্যই মেডিসিন আনতে হবে এবং পালস অক্সিমিটার এ ব্যাটারি আনতে ভুলে গেছি। দিতে পারবে?

তার প্রথম প্রশ্ন ছিলো “আপু, আপনি কি পাগল? ওখানে তো কেউ যেতে চায় না। আপনি কেন গিয়েছেন? আপনি বের হয়ে আসেন যা লাগে আমি ইনশাআল্লাহ আপুকে দিয়ে আসব।” ছেলেটা কথা রেখেছিল।

এর মাঝে ওই রোগীর চেস্ট পেইন, পালমোনারি এম্বোলিজম, ডিভিডি অনেককিছু ডেভলপ করে। আমি যখন একটু বেশি টেক কেয়ার করতে যাচ্ছিলাম, সে কথা বলাই বন্ধ করে দিচ্ছিল।

আল্লাহর রহমতে তার থার্ড স্যাম্পল নেগেটিভ আসে। কিন্তু পা তখনো নাড়াতে পারছিল না। এবার প্রথমই আমাকে জানায়, শারমিন আমাকে অমুক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।

বিশ্বাস করুন, তিনটি এম্বুলেন্স এবং একটি প্রাইভেটকার মাঝ রাস্তা পর্যন্ত আসার পরে আমাকে না করে দিয়েছে যখন শুনেছে আমি কুর্মিটোলা যাব।

অবশ্য আমি এগুলো দেখতে দেখতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি। আমি যখন কোথাও যাই ,কারো কাছে যাই তারা তখন আমাকে ভয় পায়, এভয়েড করার চেষ্টা করে এবং করাই উচিত। কারণ এর আগে গত দুই মাসে আমার বেশিরভাগ সময় হাসপাতাল অথবা রাস্তায় কাটিয়েছি। সেই মুহূর্তে আবারো মোবারক এসে আমাকে উদ্ধার করে। এম্বুলেন্স পাঠিয়ে মেয়েটিকে তার কাঙ্ক্ষিত হাসপাতালে নিয়ে আসে। ধন্যবাদ ডক্টরস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট।

যাইহোক, এই রোগী অবশেষে সুস্থ হয়ে কাজে লেগে গিয়েছেন।

এখন আমার কথা হচ্ছে, ফুল সেট পিপিই পরে ওই তিনজন নার্স ওখানে কী করছে তাহলে? ভ্যারেণ্ডা ভাজতেছেন? গল্পগুজব করতে যাচ্ছেন? যদি ওই মৃত্যুপুরীতে নাই ঢুকে তাহলে বেতন কেন নিচ্ছে? কি সেবা দিচ্ছেন তারা? এর কোনো জবাবদিহিতা নাই? অনেকে বলবেন ডাক্তার কোথায় ছিল?

ওখানে ২২-৫২ মত ক্যাবিন ছিল, একজন ডাক্তার। তিনি সকাল থেকে কেবিন টু কেবিন দৌঁড়ে চলেছেন। এই সিস্টারদের তাহলে কাজটা কি? এর জবাব আমি কার কাছে চাইবো?

যাদের পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত শুধুমাত্র তারাই জানেন কত পরিমাণ নাজেহালের শিকার তারা হচ্ছেন। ওটা বলতে পারছেন না। পরিবার এর একজন চলে গেলে পুরো পরিবার কিভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না।

তাই বলছি ,মরে গেলে রুমে বসে মরে যাব। ওই অন্ধকার রুমে একা একা কেঁদে মৃত্যুর থেকে আমার এই ছোট্ট রুমে, খোলা আকাশ দেখে, শীতল বাতাসে মরে যাওয়া অনেক ভালো!

লেখক: ডা. শারমিন ইয়াসমিন খান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত

 

সূত্রঃ যুগান্তর

সর্বশেষ - মতামত