এক রাস্তায় ৩০ ফিজিওথেরাপি সেন্টার: সিআরপির ‘সাবেক চিকিৎসক’ বলে ভাগানো হচ্ছে রোগী

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

সাভারে পক্ষাঘাত ও পুনর্বাসন কেন্দ্রকে (সিআরপি) ঘিরে আধা কিলোমিটারের মধ্যে গজিয়ে উঠেছে কম করে ৩০টি ফিজিওথেরাপি সেন্টার। যার একটি-দুটি বাদে কোনোটিরই নেই যথাযথ ফিজিওথেরাপিস্ট এবং থেরাপি দেওয়ার যথাযথ পরিবেশ বা কোনও রেজিস্ট্রেশন। অনুমতিপত্র আছে কিনা জানতে চাইলে  তারা সিআরপির দোহাই দেয়। তাদের ভাষায়, ‘চিকিৎসক আগে সিআরপিতেই চিকিৎসক ছিলেন।’ সিআরপিতে কোন পর্যায়ের চিকিৎসক ছিলেন জানতে চাইলে আর  জবাব মেলে না।

কেবল দোকানঘর, বাসাবাড়ির মধ্যে একটা-দুটা ঘর নিয়ে বাইরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বড় সাইনবোর্ড। সিআরপিতে যাওয়ার পথে দু’ধারে মুদির দোকানের মতো এসব প্রতিষ্ঠানে  কিভাবে ফিজিওথেরাপির কার্যক্রম চলে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক সাইদুর রহমান (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব মনিটরিং এর ব্যবস্থা আছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।’.

 

সরেজমিনে সিআরপি সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় বিউটি পার্লার, তোষকের দোকান এমনকি খাবার হোটেলের সঙ্গে, বাসায় সাবলেট নিয়ে, সিঁড়ির নিচে ঘর বানিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এসব ফিজিওথেরাপি সেন্টার। কোনোটিতেই চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। তবে সমন্বয়ক, ফ্রন্ট ডেস্ক ম্যানেজারসহ নানা পদের পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা বলেন,  সিআরপিতে একসময় কাজ করতেন এখানে তারাই চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। সিআরপিতে দ্বিগুণ রোগী হওয়ায় তারা সবাইকে চিকিৎসা দিতে না পারায়, এ ধরনের ফিজিওথেরাপি সেন্টার গড়ে উঠেছে বলে তারা দাবি করেন। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা সিআরপিতে কোন পর্যায়ের চিকিৎসক বা আদৌ চিকিৎসক নাকি সেবকরা এসব কাজে জড়িয়েছেন তার সদুত্তর মেলেনি।

সিঁড়ির নিচে ও পাশে মিলিয়ে সিআরপির উল্টোদিকে এশিয়ান ফিজিওথেরাপি সেন্টার। সেখানে ঢুকতে হয় চাপা একটি গেট দিয়ে মাথা নিচু করে। সেখানকার দেখভালের দায়িত্বে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ এক ব্যক্তি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই আধাকিলো রাস্তায় অর্ধশত ফিজিওথেরাপি সেন্টার আছে। আমাদেরটা ছাড়া সব কয়টা ভাঁওতাবাজির ওপর চলছে।’.

এশিয়ান ফিজিওথেরাপি সেন্টার

একজন রোগী নিয়ে এসেছেন বলে প্রতিবেদক জানালে বেশকিছু প্রশ্নের জবাব মেলে তার কাছ থেকে। সিআরপির চেয়ে এখানে মনোযোগ দিয়ে চিকিৎসা করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ডাক্তারতো সিআরপিতেই কাজ করতেন। এখন উনি নিজের ব্যবসা খুলেছেন। এখানেতো প্রত্যেক বাসায় ফিজিওথেরাপি দেওয়া হয় লেখা আছে, আপনাদেরটাই যে আসল এটা রোগীরা বুঝবে কি করে প্রশ্নে তিনি বলেন, ভেতরে দালালরা আছে। তারা দেখে কোন রোগী সিআরপিতে সিডিউল পাচ্ছে না। তখন সেই রোগীকে জানায়, আমাদের এখানে একই ব্যবস্থা আছে। আর এখানকার সব ফিজিওথেরাপি সেন্টারেই রোগীরা টানা ঘরভাড়া নিয়ে থেকে চিকিৎসা নিতে পারেন। মাসে ঘর ভাড়া চার থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত আছে।.

আপেল ফিজিওথেরাপী

এশিয়ানের পাশেই ডা. মো. আপেল মাহমুদ নিজের নামেই খুলে বসেছেন আপেল ফিজিওখেরাপি সেন্টার। বাসার সামনে একটি রুমে ঢুকতেই একজন রোগী স্ট্রেচারে উল্টো হয়ে শোয়া, অনবরত কোমরের অংশ কাঁপছে। কেন এখানে এসেছেন, সামনেইতো সিআরপি আছে জানতে চাইলে রোগীর সঙ্গে থাকা একজন বললেন, এইমাত্র এলাম। যিনি নিয়ে এসেছেন তিনি বলেছেন, স্টোকের রোগীর অবশ সারাতে এই চিকিৎসক খুব ভালো।

পেলভিসের দুটি হাড় একটির ওপর আরেকটি উঠে যাওয়া রোগী দেখাতে চাই জানালে আপেল মাহমুদ এই প্রতিবেদনকে বলেন, ‘এখানে এসে থাকতে হবে। ঘর ভাড়া মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা।’ রোগীর শারীরিক অবস্থা জানাতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিয়ে আসেন। আমি আগে সিআরপিতেই ছিলাম। এখন নিজের সেন্টার দিয়েছি। ব্যবস্থা ভালো।’

 

নিউ লাইফ ফিজিওথেরাপি সেন্টারনিউ লাইফ ফিজিওথেরাপি সেন্টারের সিনিয়র ফিজিওথেরাপিস্ট মো. আব্দুল বারী দাবি করেন, তিনি আগে সিআরপিতে চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন। তার ভিজিটিং কার্ডে মেম্বার অফ বিপিএ-সহ প্রাক্তন ফিজিও লেখা থাকলেও বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে চিকিৎসকদের তালিকায় তার নাম পাওয়া যায়নি।.” নিউ লাইফ-এর ভিজিটিং কার্ড

সরেজমিনে নিউ লাইফে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসক নেই। সামনে একজন রোগী ভর্তির জন্য বসে আছেন। তার কাছে সমস্যার কথা জানাতে তিনি বলেন, সিআরপির চেয়ে এখানে ভালো হবে। পরে আব্দুল বারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ‍দুটি চেম্বার আছে। একটি সাভারে আরেকটি কুষ্টিয়ায়। ভিজিটিং কার্ডে থাকা সব তথ্য সত্য।’ এত ঘুপচির মধ্যে এই ধরনের সেন্টারের অনুমোদন কোথা থেকে নেওয়া হয়েছে প্রশ্নে তিনি জবাব দেননি।.

গাজীপুর ফিজিওথেরাপি সেন্টার
গাজীপুর ফিজিওথেরাপি সেন্টারের চিকিৎসক অজিত কুমার মণ্ডলের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘আমি সিআরপির চিকিৎসক ছিলাম না। কিন্তু এভাবেই সহজে রোগীদের বোঝানো যায়। আমি ওখান থেকে ফিজিওথেরাপি কোর্স করেছি। বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ করেছি। কিন্তু ওখানকার চিকিৎসক বলে যে পরিচয়গুলো দেওয়া হয়,সেগুলো ঠিক না। ভিজিটিং কার্ডে এমনভাবে লেখা হয় যাতে বুঝা না যায়।

এদিকে সিআরপির চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘এরা কেউই আমাদের চিকিৎসক ছিলেন না। কেউ কেউ শিক্ষার্থী ছিলেন।’ সিআরপির নাম ব্যবহার করে তারা রোগীকে আকৃষ্ট করতে চায়, এমন খবর তিনি শুনেছেন বলে আরও বলেন, ‘সিআরপির মধ্যে একাধিকবার এসব সেন্টারের দালাল ধরা পড়েছে এবং আমরা পুলিশেও দিয়েছি।’ এদের অনুমোদনের বিষয়ে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সূত্র : বাংলাট্রিবিউন