এক মায়ের নবান্ন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

পার্ল এস বাকের উপন্যাস ‘মা’। চীনের এক পল্লীর জীবন গাঁথা। উপন্যাসের নাম যখন মা তখন বোঝাই যাচ্ছে মা এর প্রধান চরিত্র। সাহিত্যে ‘মা’ নামে আরো উপন্যাস লেখা হয়েছে। ম্যাক্সিম গোর্কি, গ্রাতসিয়া দেলেদ্দা, বা আমাদের দেশের অনুরূপা দেবী লিখেছেন এই নামে। সবার মা থেকে পার্ল এস বাকের মা সম্পূর্ণ আলাদা, কেন আলাদা সেটাই বলছি।

 

পার্ল এস বাকের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ায়। জন্মস্থানের বিশাল প্রান্তর, পাহাড়, নদী বাকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। সেখানে জড়িয়ে থাকে মাটির গন্ধ। আর সেই সঙ্গে হৃদয়ের গভীরে জায়গা করে নেয় মাটি ছোঁয়া মানুষেরা। তার ছোটবেলা কাটে চীনে বাবা মায়ের সঙ্গে। আর এখানকার মাটিকেও তিনি ভালোবেসে ফেলেন। সব সময় সব জায়গার মাটি আর মানুষ তাকে একই ভাবে আলোড়িত করেছে। তাই তিনি যখন ‘গুড আর্থ’ লেখেন তখন মাটি আঁকড়ে থাকা মানুষের হৃদয়ের কথা উঠে আসে অনায়াসে। মাটির সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে মায়ের সম্পর্ক। মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখে মাটিও তেমনি কোলে তুলে নেয় তার সন্তান মানুষকে। আর সেই মা’কে নিয়েই পার্ল এস বাক লেখেন তার ‘মা’ উপন্যাস।

 

এই মায়ের নেই কোন আদর্শের লড়াই, নেই কোন বিপ্লব। এ একেবারেই আটপৌরে এক মায়ের কাহিনী। যে মায়ের জাতির জন্য লড়াই নেই কিন্তু আছে তার নিজের সংসার নিয়ে সংগ্রাম। যে মায়ের জীবনে নেই বিপ্লবের ব্যাপকতা, আছে তার ক্ষুদ্র পরিবারের জন্য অস্তিত্বের লড়াই। মামুলি একটা গ্রামের সাধারণ এক চাষা বৌয়ের চরিত্রে যা যা থাকে তার সবকিছুই দৃশ্যমান পার্ল বাকের মায়ের মধ্যে। আর চাষি পরিবারে বা তার চৌহদ্দিতে যা কিছুই ঘটমান তার সবই আসে আমাদের এই মায়ের জীবনে। আসে সুখ, আসে পারিবারিক কলহ, আসে খেদ, আসে দুর্বিষহ দুঃখ, আসে বেদনা, আসে ভ্রংশন, আসে অনুশোচনা, আসে নতুন সূর্য। সবই আসে জীবন ধারার নৈমিত্তিক ঘটনায় সওয়ার হয়ে। আর তার মধ্যেই প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে আসে অন্য পার্বণের মতো নবান্ন। জমি কর্ষণ, বীজ বপন আর ফসল কাটার কর্মময়তার পরতে পরতে জড়িত মায়ের জীবন। উপন্যাসে মায়ের কোনো নাম উল্লেখ নেই। মা নামেই চিত্রিত হয়েছেন তিনি। মায়ের স্বামী, মায়ের সন্তান বা মায়ের শাশুড়ি এভাবেই বর্ণিত সবার পরিচিতি। মাটির যেমন কোনো নাম হয় না তেমনি মা সবাইকে আগলে রাখে তাঁর সর্বজনীনতা দিয়ে। মায়ের সর্বময়তাই তাঁকে এনে দিয়েছে এই রূপ। স্বামী তাকে ত্যাগ করার পর সব কিছু তুলে নেয় নিজের কাঁধে।

 

লেখক মায়ের জীবনকে তুলে ধরেন কর্মমুখরতা দিয়ে, “মা নুয়ে মুঠো মুঠো করে ধান কেটে আঁটি বাঁধে। আঁটিগুলো এক জায়গায় স্তুপীকৃত করে রাখে। ফসল কাটার মওসুমে নিঃস্ব ধান কুড়োনীর দল মাঠে পড়ে থাকা ধান কুড়োতে আসে। তার কাছে এলে সে তার ঘর্মাক্ত মাটিমাখা মুখে তাদের গালাগালি দেয়, ‘ওরে নচ্ছার কুড়োনীর দল! আমি যে তোদের চেয়ে গরীব। আমাকে সাহায্য করার মত কোন পুরুষ নেই। চোরের দল এখান থেকে পালা।’ সে তাদের মা বাপ তুলে এমনি প্রচণ্ড গালাগালি দেয় যে তারা ভয়ে পালিয়ে যায়।” উৎপাদিত ফসলের বিন্দুমাত্র যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি তাঁর। এ সতর্কতা তাঁর নিজের সংসারের জন্য। দক্ষ ভূমি কর্ষকের অনুপস্থিতিতে উৎপাদনের অপ্রতুলতা। আর সেই অকিঞ্চন ফসলে সাংবাৎসরিক ভরণ-পোষণের দুর্ভাবনাই তাকে এমন কঠিন করে তোলে। আসন্ন নবান্নের উৎসবের আনন্দও তাঁকে মুক্তি দিতে পারেনা এই চিন্তা থেকে। বরং সংসারকে সচল রাখতে আরো দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা চলতে থাকে। ‘সে আঁটি আঁটি করে ধান মাড়াইয়ের জন্য আঙিনায় নিয়ে আসে। মহিষটাকে প্রস্তর খণ্ডের সঙ্গে যুতে দিয়ে হেমন্তের রোদে সারা দিন ধান মাড়ায়।’ মাটি যেমন তার বুক ফাটিয়ে উৎপাদন করে ফসল, মাকেও দেখা যায় সমান মমতায় সন্তানের মুখের গ্রাস আগলে রাখে। ‘এমনি করে ফসল তোলার কাজ শেষ হয়। দুশ্চিন্তা আর দৈহিক পরিশ্রমে মায়ের শরীর ভেঙে পড়েছে। শরীর তার কঙ্কালসার হয়ে গেছে। গণ্ডদেশ আর ওষ্ঠদেশ ছাড়া সারা দেহের রং পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। বুকের দুধ শুধু পুরোপুরি আছে। অনেক মেয়ে নিজের দেহ পুষ্ট করে মাত্র; সন্তানের জন্য কিছু সঞ্চয় করে না। মা অন্য ধাতের মেয়ে। তার মাতৃত্ব নিজের দেহকে শোষণ করে সন্তানের আহার সঞ্চয় করে।’

 

এমন ভাবেই নিজের সংসার আর সন্তানের খাদ্য সঞ্চয়ের আত্মপ্রসাদ মাকে উজ্জীবিত করে রাখে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও। যদিও জানে হেমন্তের এই সুন্দর সকালটা তিক্ত করে দিতে নায়েব আসবে। নায়েব আসবে জমিদারের ফসলের ভাগ নিতে। আর নায়েবের নির্দেশ মেনে নিয়েই জমিদারের ফসলের ভাগও দিতে হবে। সেখানেই শেষ না, ফসলের ভাগ দেওয়া হয়ে গেলে নায়েবের সম্মানে নবান্ন উৎসব করতে হয়, দিতে হয় ভোজ। সেই ভোজ উৎসবও করুন সুর বাজায় তাদের সংসারে। “ছেলে-মেয়েরা লোভে রান্না ঘরে ঘোরাফেরা করে। ছেলেটা বলে, ‘এই মোরগটা যদি আমাদের জন্য রান্না করতে। এটা যদি আমরা খেতে পেতাম!’  মা বিরক্তির সুরে জওয়াব দেয়, ‘এ খাবার বড়লোকের, আমাদের মতন গরিবের জন্য নয়।” তবুও দিন কাটে মায়ের। ফসল ফলিয়ে আর সংসারের আর দশটা কাজ করে ভুলে থাকে স্বামীকে। মনে পড়ে তখনই যখন তার অভাবটা তীব্রতর হয়ে ওঠে। মনে হয়তো পড়ে সর্বদাই, কিন্তু বুকের কঠোর সংযম ঠেলে সেটা বের হয় কদাচিৎ। হয়তো তখন যখন লেখক লেখেন, ‘বসন্তের মাঝামাঝি সময়। মা বড় ছেলেটাকে নিয়ে সারাদিন মাঠে পড়ে থাকে। তাদের ক্ষেতে কোনো রকমে চাষ দেওয়া হয়েছে, যদিও তার স্বামী থাকলে যেমনটি হতো তেমনটি হয়নি।’

 

এমনি করে দিন চলে যায়, ঘুরে ঘুরে আসে নতুন বছর। নতুন হেমন্তে নবীন ফসলের ঘ্রাণ। সুফলা জমিতে বপন করা বীজের পরিণত অবয়বকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তারা। উৎসবে মেতে ওঠে সবার মন। ফসলের ভারে নুয়ে পড়া তরুর ছোঁয়াতেই মাটির পরিতৃপ্তি। আর মায়ের বুকে হাহাকার বেজে ওঠে এখানেই। আহাজারির সুর শুনি লেখকের লেখনিতে, ‘আজ সে চারদিকে চোখ তুলে তাকায়। কচি সবুজ কিশলয়ে উইলো গাছ ভরে গেছে। নাশপাতি গাছের শাখায় শাখায় সাদা পুষ্পের সমারোহ, নতুন পাতার ফাঁকে ফাঁকে ডালিম গাছে আগুন লেগেছে; দমকা গরম হাওয়া এক আধবার ঝাপটা দিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। মা বুঝতে পারেনা কোনটা মধুরতর। দমকা হাওয়ার ক্ষণিক স্তব্ধতা আর চষা মাটির সোঁদা গন্ধ, না দমকা হাওয়ায় ভেসে আসা সুরভি। এই দমকা হাওয়ার ঝাপটা আর ক্ষণিক স্তব্ধতায় চলতে চলতে মা আপন দেহে সুস্থ তারুণ্যের শিহরণ অনুভব করে, স্বামীর সঙ্গ কামনায় দেহ তার অধীর হয়ে ওঠে। ’ এই চোখ তুলে চাওয়া তার তখনই যখন ক্ষেতে কাজ করতে করতে খবর পায় তার জা’য়ের প্রসব বেদনা উঠেছে। ছেলেকে কাজের ভার দিয়ে মা ছোটে তাকে সাহয্য করতে। আর যেতে যেতে তার মন প্রাণ হাহাকার করে ওঠে। ‘বিয়ের পর থেকে প্রায় প্রতি হেমন্তেই সে সন্তান প্রসব করেছে কিন্তু এই বসন্তে দেহ তার বন্ধ্যা, গর্ভাধার শূন্য।

 

এক কালে গর্ভে সন্তান ধারণ তার পক্ষে সাধারণ ব্যাপার ছিলো; এ ছিল বারবার ঘটার মতন ব্যাপার, কিন্তু এখন সন্তান ধারণ আর সন্তান প্রসব তার কাছে আনন্দদায়ক ব্যাপার মনে হয়। বর্তমানের নিঃসঙ্গ জীবন তার কাছে বেদনাদায়ক। তার স্বামী ফিরে না এলে সে আর সন্তান প্রসব করতে পারবে না, এই কথা ভেবে তার বুকে যন্ত্রণা অনুভূত হয়। সহসা তার বুকের যন্ত্রণা বিলাপ হয়ে বেরিয়ে আসে, ‘ওগো তুমি ঘরে ফিরে এসো – ফিরে এসো।’ হেমন্তের ভরা ক্ষেত এই মাটির, এই প্রকৃতির সার্থকতার চিত্র। মাটি তখনই ধন্য যখন তার বুকজুড়ে খেলে বেড়ায় পাকা ফসলের ঢেউ। এ যেন মাতৃত্বের আর এক রূপ। উর্বর জমি যেমন আবাদ না হলে পরিপূর্ণ হয় আগাছায়, তেমনি করেই বোধ হয় এই উপন্যাসের মায়ের এই স্রংসন। কিন্তু এরপরও মাটি যেমন তার বুকে অঙ্কুরিত সব তরুকেই সমান মমতায় বড় করে তোলে মায়ের মাতৃত্বও তেমনি। মাটি জানে না কোনটা ফসলের গাছ আর কোনটা আগাছা। সব আত্মদংশন সহই মায়ের বুকে জাগিয়ে তোলে মমতাময় মাতৃত্ব। লেখক তাকে বর্ণনা করেন এভাবে, ‘এ এক অদ্ভুত মাতৃত্ব। সবার চোখের অন্তরালে একে লুকিয়ে রাখতে হবে। রাতের অন্ধকার নির্জনতায় ঘুমন্ত সন্তানদের অগোচরে আতঙ্কিত চিত্তে তাকে এ মাতৃত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যন্ত্রণা যতই কঠিন হোক, মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলা যাবেনা। আরো অদ্ভুত ব্যাপার, অন্যান্য সন্তানদের বেলায় সে দিব্যি খেয়েছে দেয়েছে; কিন্তু এখন একটা কিছু মুখে দিলেই তা বমি হয়ে বেরিয়ে আসে। গর্ভস্থ ভ্রুণটা যেন আগাছার মতন বেড়ে চলেছে, তার দেহকে শুষে খাচ্ছে, অথচ এই আগাছার চিহ্নটুকু পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হবে।’ পতিত জমির আগাছার মতোই হয়তো এক সময় তা উৎপাটিত হয়। কিন্তু সেটা সন্তানের প্রতি মায়ের ঘৃণা থেকে নয়। এটা তাকে করতে হয় সমাজের দিকে চেয়ে, তার অন্য সন্তানের দিকে চেয়ে, তার সংসারের কথা চিন্তা করে।

 

অন্যদিকে তার নারীত্বের হাহাকার জেগে থাকে সমান ভাবে। তার এই মিলনের আকুতি শুধুই নবীন ফসল অঙ্কুরোদ্গমের আকাঙ্ক্ষা থেকে। ‘এই দুঃখ-দুর্দশা, ব্যথা-যন্ত্রণা সত্ত্বেও সেই শহুরে লোকটার কথা মা ভুলতে পারে না; শহুরে লোকটার প্রতি তার আকর্ষণ কমে না। লোকটার প্রতি তার মনে যুগপৎ ঘৃণা ও আকর্ষণ জাগে। তার গর্ভস্থ গোপন গ্রন্থিটুকুই যেন লোকটার প্রতি তাকে আকর্ষণ করে।’ সমাজের শৃঙ্খলই এক সময় তাকে নিরস্ত করে। সে পড়ে থাকে পতিত জমির মতো, বন্ধ্যা মাটির মতো। ক্রমে তার ব্যর্থতা তাকে হতাশ করে তোলে। তার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন ছোট ছেলেটাও তাকে ছেড়ে চলে যায়। ছেলের মৃত্যুতে মনে হয় মায়ের জীবনের সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই হেমন্তের সকালে আবার নতুন আলোয় মায়ের দেহ মন উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। বড় ছেলে এসে খবর দেয় তার পুত্রবধূ দীর্ঘ বন্ধ্যাত্বের পর পুত্র সন্তান প্রসব করেছে। মা তার সদ্য পুত্র হারানো শোকও ভুলে যায়। বহুদিন পর প্রাণ খুলে হেসে ওঠে নবীন ফসলের হাতছানিতে।

সূত্র: এনটিভি