অসঙ্গতি : পর্ব-১

এক কাজীতেই অবৈধ বিবাহে অস্থির রাজশাহীর আদালতাঙ্গন

কাজী শাওন। ফাইল ছবি

শেখ রহমত উল্লাহ:

রাজশাহীর আদালত অঙ্গন এখন অবৈধ কাজী আর দালালদের দখলে। বাল্যবিয়ে, সাক্ষী ছাড়া বিয়ে কিংবা নামসর্বস্ব বিয়ে এর সবই এখন মিলছে একই যায়গায়। এই ধরনের বিয়ের নামে কোর্টে আসা সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে প্রতিনিয়তই হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। আবার দালাল ও কাজীর যোগশাজশে এমন কারবার হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে নব-দম্পতিদের করা হচ্ছে স্বর্বশান্ত। শুধু তাই নয়; বিয়ের কাবিননামা সংগ্রহের জন্য অসহায় দম্পতিরা নামকোয়াস্তে এসব কাজীদের দিতে হচ্ছে ৫-৭ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- অবৈধ বিয়েকে কেন্দ্র করে হালে রাজশাহীর আদালতাঙ্গনে একটি দালালচক্র বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই প্রতারক চক্রের মধ্যে একাধিক অনিবন্ধিত কাজীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। এরা বিভিন্ন সময়ে আদালত অঙ্গনে বৈধ কাজীর সহযোগী হিসেবে পরিচয় দিলেও অধিকাংশেরই নেই মাদ্রাসায় পড়া-লেখার সনদ। শুধু তাই নয়; তারা যে কাজীর অধীনে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন তারও আদালত অঙ্গনে কাজী হিসেবে কাজ করার বৈধতা নেই।

রাজশাহীর আদালত পাড়ার বিভিন্ন দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো রয়েছে এমনই একজন কাজীর। তিনি হলেন- কাজী শাওন। তার পুরো নাম মোকাদ্দিম হোসেন শাওন। রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার বাক শিমইল ইউনিয়নের নিবন্ধিত কাজী হিসেবে পরিচিত হলেও অধিকাংশ সময়ই তিনি রাজশাহীর আদালত অঙ্গনের বিয়ে রেজিস্ট্রির কাজ করেন। তিনিই অবৈধ আদালত পাড়ায় ডজন খানেক দালাল নিয়োগ করে রেখেছেন। এই বিয়ের কাজ হাতিয়ে নেয়ার জন্য দালালের পাশাপাশি একাধিক সহযোগীও রয়েছে তার।

অনুসন্ধানে জানা গেছে- তিনি শুধু কাজীই নন তাঁর রয়েছে নামি-বেনামি একাধিক স্ট্যাম্প ভ্যান্ডারের লাইসেন্স। এই লাইসেন্সকে পুজি করে আদালত অঙ্গনে প্রবেশের সুযোগ পেলেও এর আড়ালেই অবৈধ কাজীর ব্যবসা পরিচালনা করছেন তিনি। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কাজী হিসেবে কোন নিয়োগপত্র না থাকলেও রাসিক এর ৫ নং ওয়ার্ডের কাজী আব্দুস সাত্তারের মৃত্যুর পর প্রশাসনের লোকদের হাত করে ওই ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত কাজী হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছেন কাজী শাওন। রাজশাহী কোর্টের রাস্তার পাশেই একটি ফ্ল্যাটে খুলেছেন তাঁর নিজস্ব কাজীর চেম্বার।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে- কাজী শাওন একাধারে মোহনপুর উপজেলার বাকশিমোইল ইউনিয়নের কাজী, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ৫নং ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত কাজী। এছাড়াও পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার ১ ও ৪ নং ওয়ার্ডেরও ভারপ্রাপ্ত কাজী। নওহাটা বাজারেও তার চেম্বার রয়েছে। এগুলো ছাড়াও রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরেও তিনি নিয়োগ করে রেখেছেন প্রতিনিধি। এইসব জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিয়ে নিবন্ধন করেন। এর অধিকাংশই বাল্যবিবাহ। ভুয়া এফিডেভিটের মাধ্যমে ছেলে মেয়ের বয়স পরিবর্তন, বাল্য বিবাহসহ নানা অনিয়মের দায়ে তার বিরুদ্ধে রাজশাহী ও চাাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে একাধিক মামলাও।

কাজী শাওনের এক ঘনিষ্ঠজন জানান, কাজী শাওন সরকার নির্ধারিত বিবাহ ও তালাক রেজিস্টার বহির বাইরেও একাধিক ভুয়া রেজিস্টার বহি ব্যবহার করেন। সেই সাথে তার হেফাজতে বিভিন্ন ধরনের বিবাহের রশিদ রয়েছে। বাল্য বিবাহ, সাক্ষী বিহীন বিবাহ, অবৈধ খোলা তালাক অথবা নাম সর্বস্ব বিয়ের ক্ষেত্রে এ রেজিস্টারগুলো ব্যবহার করে থাকেন। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তার বিয়ে পড়ানোর বৈধতা না থাকায় তার তৈরি অবৈধ রেজিস্টারের মাধ্যমেই বিয়ে নিবন্ধন করে প্রতারণা করে থাকেন। ফলে বিবাহের কাবিননামা হাতে পেলেও বিবাহের বা কাবিননামার বৈধতা নিয়ে বিবাহিত দম্পতিদের মনে আশঙ্কা থেকে যায়।

এগুলো ছাড়াও কাজী শাওনের সাথে নারী প্রতারক চক্রের সখতা রয়েছে বলে জানা গেছে। তিনি মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ভুয়া বিবাহ, লাখ লাখ টাকার মোহরানা দেখিয়ে জাল কাবিননামা তৈরি করে বিভিন্ন বিত্তবান ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে ওই কাবিননামা ধরে আদালতে মামলা করে অর্থ আদায় করে থাকেন।

এমনি তার এই প্রতারণার জ¦ালে আটকা পড়েছিলেন রাজশাহী আরডিএ মার্কেটের বৈশাখী ফ্যাশান এর মালিক মো. সৌরভ। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সাল। তখন আমি ঢাকায় অবস্থান করছিলাম। তখন কাজী শাওন আমার এবং আমার খালাতো বোনের বিয়ের একটি অবৈধ কাবীননামা তৈরি করেন। যেখানে ১৫ লাখ টাকা দেনমোহর দেখানো হয়। এই কাগজকে পুঁজি করে আমার কথিত স্ত্রী ও আমার বিরুদ্ধে মামলা করলে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কাজী শাওনকে ধরলে তখন তিনি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান। কিন্তু তার এই প্রতারণার মামলা এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।’

রাজশাহীর আদালত অঙ্গনে কাজী শাওনের এমন কার্যক্রমের বিষয়ে রাজশাহী কোর্ট এর কাজী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি (শাওন) রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন করে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ করেছেন। তিনি মোহনপুর উপজেলার বাকশিমইল ইউনিয়নের কাজী। আমার জানামতে- রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ৫ নং ওয়ার্ডের কাজীর মৃত্যুর নতুন কাজী কিংবা ভারপ্রাপ্ত কাজী নিয়োগ দেয়া হয়নি।’ কাজী শাওনের কার্যক্রম কে সম্পূর্ণ অবৈধ বলেও দাবি করেন তিনি।

এসব বিষয়ে কাজী শাওনের নিকট জানতে চাওয়া হলে তিনি এর কোনো সদুত্তর না দিয়ে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বলেন ‘এই নিয়ে সংবাদ পরিবেশন বাদ দিয়ে আমার সাথে সমঝোতায় আসেন। এতে আপনারও লাভ আর আমারও।’

জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা রেজিস্টার ড. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ৫ নং ওয়ার্ডে কাজী শাওনকে আমাদের ভারপ্রাপ্ত কাজী নিয়োগ দেয়া আছে।’ রাজশাহী মহানগরীর বাসিন্দা না হয়ে ভারপ্রাপ্ত কাজী কীভাবে হন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। ওই ফাইলটা ভালোভাবে স্টাডি করে দেখবো। যদি তিনি সিটির বাসিন্দা না হন তাহলে সিটির অভ্যন্তরের কাউকে ভারপ্রাপ্ত কাজী নিয়োগ দেয়া হবে।’

এএইচ/এস