একটি ভালো উদ্যোগ বদলে দিতে পারে অনেকের জীবন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে ভরা রাজধানীর দেয়ালগুলোর দাগ পড়া চিহ্ন যেন বলে দেয় এই শহরের মানুষদের মানবতা বোধেও কতটা কালি পড়ে গেছে। তার পরও কিছু মানুষ সে দেয়ালে সাদা রং মেখে দিয়ে সাদা মনের চিহ্ন রেখে প্রমাণ করেন, মানবতা আছে, থাকবে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের সূর্য সন্তানরাই বারবার তৈরি করবে মানবতার মানবিক দেয়াল। শীতার্ত মানুষদের জন্য গরম কাপড় সংগ্রহ করতে এমনই এক মানবতার দেয়াল তৈরি করেছে পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী। এলাকার মানুষ এবং অন্য শিক্ষার্থীরা বলছে, একটি ভালো উদ্যোগ বদলে দিতে পারে অনেকের জীবন। মানবতার দেয়াল তৈরি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে প্রশংসার জোয়ার। বিষয়টি প্রথম কে শুরু করেছে সেটা জানা না গেলেও একটি দেয়ালে মানবতার দেয়াল নামে দেখার পরে সেটাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেন দুই শিক্ষক।

গত শুক্রবার সরেজমিনে পুরান ঢাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্ক পার হয়ে কবি নজরুল সরকারি কলেজের গেট থেকে লক্ষ্মীবাজারের দিকে যেতে কলেজের ব্যাংক শাখার পাশের দেয়ালের মাঝে রংতুলিতে এক পাশে লেখা ‘আপনার যা অপ্রয়োজন দিয়ে যান’ আর অন্য পাশে লেখা ‘আপনার যা প্রয়োজন নিয়ে যান’। মাঝ বরাবর দেয়ালে লেখা আছে মানবতার দেয়াল। দেয়ালের গায়ে লাগানো হ্যাঙ্গারে ঝুলছে শার্ট, শীতের কাপড়, গেঞ্জিসহ বিভিন্ন পুরনো পোশাক। যেখান থেকে রিকশাচালক থেকে শুরু করে অনেকেই নিয়ে যাচ্ছেন শীত থেকে রক্ষা পেতে নিজের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক। এমন মানব দেয়াল তৈরি করেছেন কবি নজরুল সরকারি কলেজের অর্ণব, অনিক, ইমরান, আনোয়ার ও আকাশ নামের কয়েকজন শিক্ষার্থী। মানবতার দেয়াল প্রথম তৈরি করেন মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ইয়াসমিন আকতার এবং কিশোরগঞ্জের এক স্কুলের শিক্ষক তানজীনা নাজনিন মিষ্টি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে যাওয়ার পর মানবিক বিবেকবান মানুষেরা এই কাজে এগিয়ে আসছেন, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন বিভিন্ন জায়গায়। দেখা যায়, পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের দেয়ালে লাগানো হ্যাঙ্গারগুলোতে এলাকার মানুষ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজেদের পুরনো পোশাক এনে রাখছেন। তেমনই একজন ফাহমিদা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আসলে এই সময়টায় অনেকেই শীতের পোশাক সংগ্রহ করে এবং শীতার্তদের মধ্যে দিতে চায়; কিন্তু সঠিক জায়গা থেকে সংগ্রহ করা এবং সঠিক জায়গায় পৌঁছানো যায় না। এখানে আমরা রেখে যাচ্ছি, যার প্রয়োজন সে নিয়ে যাচ্ছে। দেখা গেল, কেউ কেউ আবার নতুন পোশাকও দিচ্ছে।’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বললেন, ‘আসলে আমরা ছেঁড়া টাকাটা ফকিরকে আর মসজিদে দেওয়ার জন্য রেখে দিই। সেটা খুবই দুঃখজনক। ছেঁড়া জামা-কাপড় দিলে সেই কাপড় পরার মতো অবস্থা থাকে না। তাই যাদের যা সামর্থ্য আছে সে অনুযায়ী নতুন কাপড়ও দেওয়া জরুরি।’ তবে এভাবে রেখে গেলে কেউ আবার একসঙ্গে সব নিয়ে যায় কি না? সেটা নজর রাখা হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী তুষার খান বলেন, ‘সেটা করার সুযোগ নেই। আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীরা এবং পাশের ফুটপাতের দোকানিরাও নজর রাখেন। প্রযুক্তির যুগে যখন মানুষ সারাক্ষণ অনলাইনে নিজের চিন্তাভাবনা, আবেগ, অনুভূতি বিলাতে ব্যস্ত! তখন কোন চিন্তা থেকে এমন উদ্যোগ নিলেন এই কয়েকজন? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উল্লিখিত নামের সবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন কালের কণ্ঠর ৩৬০ ডিগ্রি। অনেকেই ঢাকার বাইরে থাকায় আবার কয়েকটি ছদ্ম নাম থাকায় পাওয়া যায়নি। তবে একজনকে পাওয়া গেলেও নাম প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নন। তিনি বলেন, ‘‘আসলে মানুষ মানবতা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। সবাই নিজেদের মধ্যে শত্রুতা বাড়াতে ব্যস্ত।’ ‘ভয় কিসের আমি তো আছি’ এই কথা বলার মতো কেউ নেই। আমরা কয়েকজন চিন্তা করেছি, এমন কিছু করি, যাতে করে আমরা না থাকলেও মানুষের উপকার হবে। সে জন্যই এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া।”

রিকশাচালক আব্দুল হাই নিজের জন্য শীতের কাপড় নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভাই, গরিব মানুষ, তাই কিনতে পারি না। আবার মাইনষের কাছ থেইক্যা হাত পাইত্তা নিতেও শরম লাগে। এই জায়গা ঝুলাইন্না আছে দেইখা ভাবছি কেউ দেখব না; কিন্তু আপনি দেইক্কা ফেলছেন। তয় যারা এই কাম (ব্যবস্থা) করছে, তারা খুব ভালা মানুষ। আল্লাহ হেগো ভালা করুক।’