একটি ছোট্ট ভুলে পুঠিয়ার সেই জাহাঙ্গীরের পরিবার পথে বসতে চলেছেন

মইদুল ইসলাম মধু, পুঠিয়া:

গত ২০ জানুয়ারী দড়িদ্র অটোচালক জাহাঙ্গীর আলমকে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এমপি পরিচয় দিয়ে হাইওয়ে পুলিশের বগুড়া রিজিয়নের পুলিশ সুপার (এসপি) শহীদ উল্লাহর সাথে প্রতারণার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার একটি মামলা দায়েরও করেছে। সেই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

এদিকে জাহাঙ্গীরের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিলো ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সাটি। পুলিশ সেটি আটক করার পর তিনি অটোর চিন্তায় দিশেহারা হয়ে এ কাজ করেছেন। অভাবের সংসারে বিপদে পড়ে করা ভুলটি মানবিক দৃষ্টিতে দেখে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে জামিনে মুক্ত করে দেয়ারও অনুরোধ করেছেন পরিবারের সদস্যা। তিনি দ্রুত জামিন না পেলে পরিবারটি পথে বসে যাবেন বলেও দাবি করা হয়। ঘটনার পর পরিবারের সদস্যরা লজ্জায় সমাজে মুখ দেখাতেও পারছেন না। গত ১৯ জানুয়ারী অটোরিকশা নিয়ে মহাসড়কে উঠার অপরাধে হাইওয়ে পুলিশ জাহাঙ্গীরের অটোরিক্সাটি আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে যায় এবং পরের দিন ২০ জানুয়ারী তিনি প্রতারণা করে অটোরিক্সাটি আনতে গিয়ে হাইওয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন।

জানা গেছে, অটোটি আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে জাহাঙ্গীর ছুটে যান রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিবপুরে অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়িতে। সেখানে তাকে জানানো হয় উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সুপারিশ হলে তার অটোটি ছেড়ে দেয়া হবে। পরে একটি চিরকুটে হাইওয়ে পুলিশের বগুড়া রিজিয়নের পুলিশ সুপার (এসপি) শহীদ উল্লার মুঠোফোন নাম্বার দিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। জাহাঙ্গীর আলম (৪৫) রাজশাহী জেলার পুঠিয়া পৌর সদর এলাকার কৃঞ্চপুর মহল্লার মৃত মাজেদ গাইনের ছেলে।

সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে জানা গেছে, কয়েক শতক জমির উপর একচালা টিনের দুটি কক্ষে বসবাস করেন তারা। একটিতে থাকেন তার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে অন্যটিতে জাহাঙ্গীর ও তার স্ত্রী। তবে ছেলে বাড়ি এলে তাকে খোলা বাড়ান্দায় রাত কাটাতে হয়। পরিবারের সদস্যরা জানায়, অটোরিক্সার উপর ভর করেই চলতো তার তিন ছেলে-মেয়েসহ ৫ সদস্যের সংসার। তার দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েকে অনার্স পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি বর্তমানে এমবিএ করছেন। ছোট মেয়েটি স্থানীয় একটি মহিলা কলেজে বিজ্ঞান বিভাবে একাদশ শ্রেনীর প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন। তবে ছেলেটি একাদশ শ্রেনী থেকে উত্তীর্ন হয়েই সদ্য নিয়োগ পেয়ে একটি চাকরীতে যোগদান করেছেন। তবে তিনি এখনও বেতন পাওয়া শুরু করেননি। বরং এখনও বাড়ি থেকে তার কাছে টাকা পাঠাতে হয়। জাহাঙ্গীরের ছেলে মেয়ের পড়াশোনার খরচ যোগান দেয়া থেকে শুরু করে এনজিওর ঞ্চণ পরিশোধ করা এবং সংসারের সকল খরচ বহন করতে হতো অটোটির উপর ভর করেই। বাড়িতে দেখা হয় জাহাঙ্গীরের ছোট মেয়ের সঙ্গে তিনি জানান, জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেও একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হওয়ার টাকা ছিলোনা তার। কলেজের এক শিক্ষকের কাছে ভর্তির এক হাজার টাকা ধার নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। এখনও তার ধারের টাকা পরিশোধ করতে পারেনি।

তিনি বলেন, কলেজে গেলে যখন স্যারের সঙ্গে দেখা হয় তখন খুব লজ্জা লাগে নিজের কাছে। আমাদের পড়াশোনা করানোর জন্যই বাবা দিনরাত অটো নিয়ে রাস্তায় ভাড়া মেরে বেড়াতো আমাদের জন্যই তিনি এখন জেলে।

সদ্য চাকুরীতে যোগদান করা জাহাঙ্গীরের ছেলে জানান, সম্প্রতি তিনি চাকরীতে যোগদান করেছেন। সবে মাত্র প্রশিক্ষন শেষ হয়েছে এখনও বেতন পাওয়া শুরু করেননি। মাঝে মাঝেই তার বাবার কাছে টাকা নিতে হয়। কর্মস্থল থেকে বাড়িতে বেড়াতে এসেই দেখেন তার বাবার এই অবস্থা। তিনি আরো জানান, গ্রেপ্তারের পর তার বাবা কে দেখতে ফাঁড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে তার চোখের সামনে বাবার হাতে হ্যান্ডকাপ পড়িয়ে গলায় প্রতারকের সাইন্ডবোর্ড ঝুলিয়ে ছবি তোলা হচ্ছিলো। যে দৃশ্য তার কাছে খুব খারাপ লেগেছে।

মামলার এজাহার সুত্রে জানা গেছে, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ইজিবাইক (থ্রী-হুইলার) আটকের পর চালক জাহাঙ্গীর নিজের পরিচয় গোপন করে হাইওয়ে পুলিশ বগুড়া রিজিয়নের পুলিশ সুপার (এসপি) শহীদ উল্লার মুঠোফোনে কল করে এবং রাজশাহী-৫ পুঠিয়া-দুর্গাপুর আসনের আ.লীগ দলীয় বর্তমান সংসদ সদস্য প্রফেসর ডাঃ মুনসুর রহমান বলে নিজের পরিচয় দেন। এছাড়াও মুঠোফোনে জাহাঙ্গীর আলম নামের এক চালকের অটোরিক্সাটি ছেড়ে দেয়ারও নির্দেশ দেন এসপিকে। মামলার বাদী ও হাইওয়ে পুলিশ শিবপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইও) কাজল কুমার নন্দী জানান, ফোন নাম্বার দেখে এসপি স্যারের সন্দেহ হলে তিনি এমপি মনসুর রহমানের মোবাইল নাম্বারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন। নাম্বার না মেলায় তিনি মুঠোফোন ওয়ালাকে অটো নিতে ফাঁড়িতে যেতে বলেন।

কাজল কুমার নন্দী জানান, জাহাঙ্গীর অটো নিতে ফাঁড়িতে এলে (ভুয়া এমপি পরিচয় দানকারীর নম্বরে) আমি সেই নাম্বারে ফোন করি। ফোনটি জাহাঙ্গীরের পকেটে বেজে উঠে। পরে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি তিনি সব স্বীকার করেছেন। তার বিরুদ্ধে হাইওয়ে পুলিশ বাদী হয়ে প্রতারনার মামলা দায়ের করেছে। সেই মামলায় তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতেও প্রেরণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী জানান, ছেলে মেয়ের পড়াশোনার খরচ, সংসার খরচ ছাড়াও সাপ্তাহিক চারটি এনজিওর কিস্তির টাকা সব মিলে প্রতি মাসে অন্তত ১৫/২০ হাজার টাকা আয় করতে হয় তার স্বামীকে। এনজিও থেকে ঞ্চণ নিয়ে অটোটি কিনেছিলেন তারা। যার দেনা এখনও পরিশোধ হয়নি। দু’দিন আগেও কিস্তির টাকা দিতে পারেনি বলে একটি এনজিও থেকে নোটিস পাঠানো হয়েছে।

তিনি কান্না করতে করতে বলেন, অটোডা হারানির পর কত জায়গায় ধরনা দিছে লোকটা তাও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। অভাবের সংসার অটোডাই ছিলো একমাত্র সম্বল। এখন অটোও নাই মানুষটাও নাই। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আমারে কারো সাতে কিছু বুলেনি আমরা জাইনলে তো এরকম হইতেই দিইনে। অটোর চিন্তায় সারা রাইত ঘুমায়নি সোকালে উইটিই বাড়ি থাইকি বাইর হয়য়াই এ কাজ করিছে। অপরাধ করলেও নিজের জন্যই তো করিছে মানুষের জন্যই করিছে এডি কেও দেখলো না। ঘটনার পর তারা সমাজে মুখ দেখাতে পারছেন না।

স/আর