‘এই-যে হিয়া থরথর কাঁপে আজি…’ গাফ্‌ফার ভাই

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ 

‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’। ক্লান্তি থেকে কি আসলে সব সময় নিস্তার মেলে? মনের ভিতরের অজানা কষ্টগুলোর কথা এ শিরোনামেই লিখলেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। সময়টা ১৯৭৪ সাল। এক কঠিন পরিস্থিতির ভিতর দিয়েই এগিয়ে চলছিল সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ। সে সময় দেশ ছাড়ছিলেন তিনি। প্যারালাইজড হয়ে পড়া অসুস্থ স্ত্রীকে চিকিৎসা করাবেন লন্ডনে। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। বঙ্গবন্ধু সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তার পরও অজানা আশঙ্কা কাজ করছিল মনে। প্রিয় জন্মভূমির বাইরে কত দিন থাকবেন জানেন না। দেশের ভিতরে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই ভালো লাগছিল না। সংবাদকর্মী হিসেবে চোখে পড়ছিল চারদিকের নানামুখী ষড়যন্ত্র। আওয়ামী লীগের ভিতরেও ঢুকে পড়ে চক্রান্তকারীরা। বিদায়ের আগে তিনি দেখলেন, মুহসীন হলের সেভেন মার্ডার। এ খুন আরও উসকে দেয় চারপাশের ষড়যন্ত্রকে। খুনের দায়ে আটক হলেন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান। দুই গ্রুপের এ সংঘাত আতঙ্কগ্রস্ত করল আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকেও। বিদায় বেলায় ভয় ধরাল তাঁর মনে। তিনি কলম তুলে নেন হাতে। শুনতে থাকেন রবীন্দ্রনাথের সেই গান, ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু,/পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু।/ এই-যে হিয়া থরথর/কাঁপে আজি এমনতরো/এই বেদনা ক্ষমা করো/ক্ষমা করো প্রভু।/এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,/পিছন-পানে তাকাই যদি কভু।/দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায়/শুকায় মালা পূজার থালায়,/সেই ম্লানতা ক্ষমা করো/ক্ষমা করো প্রভু।’ পুরো গানটি শুনলেন। তারপর শেষ করলেন লেখা। মনের বেদনা আর দেশের কঠিন বাস্তবতা, অজানা আশঙ্কার কথা নিয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক জনপদে।

আজ যখন এ গানটি শুনছি তখন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী আর আমাদের মাঝে নেই। একুশের অমর গানের কিংবদন্তি বিদায় নিয়েছেন। চলে গেছেন চিরতরে। বাংলাদেশ এখন অপেক্ষা করছে তাঁর লাশের জন্য। কিংবদন্তিকে শেষশ্রদ্ধা জানানো হবে ঢাকায়। দাফন করা হবে বনানী গোরস্থানে। জানি এ জগতে কেউ চিরস্থায়ী নয়। তার পরও কিছু ক্ষণজন্মা মানুষ আসেন যাঁরা অমরত্ব নিয়ে যান। গাফ্‌ফার চৌধুরীও তেমনই। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’- এই একটি গানই অমরত্ব দেবে তাঁকে। এ গানের পর তিনি আর কিছু না লিখলেও চলত। তার পরও জীবনভর দুই হাতে লিখেছেন। এমনকি শেষ সময়টাও বাদ যায়নি। হাসপাতালে তাঁর কলম থামেনি মুহূর্তের জন্যও। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত লিখে গেছেন। এভাবে সবাই পারেন না। অনেক দিন আগে এক আড্ডায় কীভাবে এত লেখেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, লিখে যেতে হয়। না লিখে উপায় কী? পেশাজীবী সাংবাদিক ছিলেন। সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন। লড়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কোনো আপস করেননি। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অসংগতি দেখলে সমালোচনা করতেন। একজন সত্যিকারের সাংবাদিকের ভূমিকা নিতেন মাথা উঁচু করে।

শুধু কলাম লেখক নন, তিনি বড় মাপের সাহিত্যিকও ছিলেন। গল্প, উপন্যাস, গান, নাটক, কবিতা, ছড়া সব লিখেছেন। সাহিত্যের সব শাখায় ছিল বিচরণ। আলোচিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- পলাশী থেকে ধানমন্ডি, রক্তাক্ত আগস্ট। তিনটি গল্পগ্রন্থ- কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সম্রাটের ছবি (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর। উপন্যাসগুলোর মধে- চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, তিমির সঙ্গিনী, নীল যমুনা (১৯৬৪), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭), ডানপিটে শওকত (১৯৫৩)। প্রথম জীবনে সৃষ্টিশীল লেখা ছিল বেশি। পরে এতটা এদিকে মনোযোগ দিতে পারেননি। কেন পারেননি একবার গাফ্‌ফার ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, আপনি স্বাধীনতার আগে অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন না কেন? জবাবে বললেন, স্বাধীনতার পর দেশ ছেড়েছিলাম স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায়। প্রবাসজীবনে কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করতে হয়েছিল। দিনযাপন করতে অনেক ধরনের কাজ করেছি। সে সময় কলাম লিখে পয়সা পেতাম। গল্প-উপন্যাসের টাকা সেভাবে আসত না। আর পত্রিকা অফিসে কাজ করে সময় পেতাম না।

 

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর লন্ডনের বাড়িতে দুবার গিয়েছিলাম। তিনি লন্ডনের বাঙালি এলাকা থেকে অনেক দূরে থাকতেন। ১৯৯৭ সালে প্রথমবার গিয়েছিলাম আমিনুল হক বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে। গাফ্‌ফার ভাইকে তুলে নিয়ে আমরা আমিন আলীর বিখ্যাত রেডফোর্ট রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম। পরের বার ক্যামেরাম্যান পল্লব ও আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সানু মিয়া। দুনিয়ার নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা, গল্প হয়েছিল। বাদশা ভাই থাকলে আড্ডাটা জমত বেশি। গাফ্ফার ভাইয়ের চোখের মণি ছিলেন আমিনুল হক বাদশা। হঠাৎ করে বাদশা ভাইও চলে গেলেন। বাদশা ভাইয়ের মৃত্যুর আগে লন্ডন গিয়েছিলাম। কথা ছিল অসুস্থ বাদশা ভাইকে আগে দেখে পরে গাফ্ফার ভাইয়ের কাছে যাব। গাড়ি চালিয়ে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন লন্ডনপ্রবাসী আমার শ্যালক আফজাল। বাদশা ভাই আর গাফ্ফার ভাই দুজন থাকতেন লন্ডনের দুই দিগন্তে। এক অঞ্চলে একবার গেলে অন্য অঞ্চলে যাওয়া কঠিন। সেদিন লন্ডনের রাস্তায় অনেক যানজট ছিল। বাদশা ভাইকে দেখে ফিরতে দেরি হয়ে যায়। গাফ্ফার ভাইয়ের বাড়িতে আর যাওয়া হলো না। ফোন করলাম। বললাম, গাফ্ফার ভাই আজ আর আসতে পারছি না। দেরি হয়ে গেল। আপনার সঙ্গে এবার আর দেখা হলো না। তিনি বললেন, বাদশাকে দেখে গেছ ভালো করেছ। বাদশার শরীরটা ভালো নেই। ওকে নিয়ে বেশি চিন্তা হয়। আমার সঙ্গে তোমার অবশ্যই আবার দেখা হবে। গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে এরপর অনেকবার দেখা হয়েছিল। কিন্তু বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে সেটাই ছিল শেষ দেখা। গাফ্ফার ভাই ঢাকা এসেছিলেন। বাদশা ভাইয়ের আরেক ভাই খন্দকার রাশিদুল হক নবাকে নিয়ে তিনি এলেন বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে। এই কিংবদন্তিকে বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে আজীবন সম্মাননা জানিয়েছিলাম আমরা। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সব সময় প্রশংসা করতেন। কালের কণ্ঠে নিয়মিত লিখতেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখতেন বিশেষ সংখ্যাগুলোয়। সর্বশেষ ১৫ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে লিখেছেন। মন খুলে প্রশংসা করেছেন পত্রিকাটির।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের ইউরোপযাত্রা হয়েছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর হাত ধরেই। আমি ফোন করেছিলাম, গাফ্ফার ভাই লন্ডন থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশ করব। আপনাকে থাকতে হবে অনুষ্ঠানে। জানি আপনার শরীরটা ভালো নেই। তার পরও থাকতে হবে। আসতে হবে। দোয়া করে যেতে হবে আমাকে। তিনি বললেন, শরীর ভালো নেই। তার পরও আসব তোমাকে আশীর্বাদ করতে। তোমার সাহসে মুগ্ধ। এই সময়ে লন্ডন থেকে কাগজ প্রকাশ করতে যাচ্ছ। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশ করছ। তোমাদের মাসুমকে (লন্ডন প্রতিনিধি) বলবে যোগাযোগ রাখতে। অনুষ্ঠানে গাফ্ফার ভাই এলেন। হুইল চেয়ারে ভিতরে প্রবেশ করলেন। সে অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, লন্ডনের মেয়র, লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের সবাই ছিলেন। গাফ্ফার চৌধুরী বলেছিলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচারিত। এখন লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশ করে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে সংবাদপত্রের জগতে। এ ইতিহাস সবাই সৃষ্টি করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শের প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সমর্থন অব্যাহত থাকবে সে প্রত্যাশাই করছি। অনুষ্ঠান শেষ করে গাফ্ফার ভাই ফিরে গেলেন। যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার জন্য দোয়া থাকল। আজ বাদশা থাকলে অনেক বেশি খুশি হতো। বাদশা তোমাকে অনেক স্নেহ করত। আমি বললাম, আরেকজন- সানু মিয়াকেও মিস করছি। এ দুজন আমি লন্ডন এলে সারাক্ষণই সঙ্গে থাকত। দেশে গেলে আমাকে ছাড়া চলত না।

প্রিয় মানুষ কখনই দীর্ঘ সময় থাকে না। লন্ডনের সানু মিয়ার চলে যাওয়ার বয়স হয়নি। হঠাৎই চলে গেলেন। লন্ডন থেকে এক সকালে ঢাকায় এলেন। এসএমএস করলেন। বললেন, আমি ঢাকায় এসেছি। কথা হবে। দেখা হবে। আমি উত্তরে লিখলাম, অবশ্যই। কয়েক ঘণ্টা পর বিপ্লব বড়ুয়া ফোন করে জানালেন, সানু ভাই চলে গেছেন। চোখের পানি রাখতে পারিনি। একজন মানুষ কিছুক্ষণ আগে বললেন ঢাকায় এসেছি। দেখা হবে। এখন শুনলাম চলে গেছেন। মানুষ এভাবে কেন চলে যায়? ছুটে গেলাম বারডেম হাসপাতালে। মিয়া আখতার হোসেন সানু শুয়ে আছেন। বিপ্লব বড়ুয়া আর এনএসআইয়ের মাসুদ আমাকে নিয়ে গেলেন লাশ দেখাতে। সানু ঘুমিয়ে আছেন। আমি তাকালাম। ভাবতেই পারছিলাম না এ ঘুম আর ভাঙবে না।

এমন আরেকটি মৃত্যুর কথা মনে পড়ছে। তিনি কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। এলজিইডির সেই কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। ২০০৮ সালের এক সকালে অফিসে বসে মেইল পড়ছিলাম। অনেক মেইলের একটি ছিল কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের। তিনি একটি গ্রুপ মেইলের সিসি পাঠিয়েছিলেন। সেই মেইলে লিখেছেন, ‘ডিয়ার অল, আমি সুইডেনে পানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ শেষে এখন আমেরিকার নিউজার্সিতে আমার ছেলে সাইফের বাসায় অবস্থান করছি। ১৫ দিনের মতো থাকব। তারপর ফিরে আসব বাংলাদেশে। আসার পর আপনাদের সবার সঙ্গে কথা হবে। দেখা হবে।’ মেইলটা পড়া শেষ করে উত্তর লেখার জন্য হাত দিলাম। লিখতে শুরু করলাম, ‘প্রিয় কামরুল ভাই, আপনার মেইল পেয়েছি। আপনি ভালোভাবে ফিরে আসুন। বাংলাদেশে আপনার এখনো অনেক কাজ বাকি।’ মেইল সেন্ড বোটামে টিপ দেব তখনই ফোন বাজল এলজিইডির প্রকৌশলী ইফতেখার সাহেবের। ফোনটি ধরলাম। তিনি বললেন, কামরুল ইসলাম সিদ্দিক স্যার মারা গেছেন। শহীদুল হাসান স্যার আপনাকে খবরটি জানাতে বলেছেন। থতমত খেলাম। মনে হলো চেয়ার থেকে পড়ে যাব। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তিনি কী করে মারা যাবেন? এই মাত্র তাঁর মেইল পেয়েছি। তিনি ছেলের বাসায় আছেন। আপনি কোথাও ভুল করছেন। ইফতেখার সাহেব বললেন, ভাই, আমি জানি আপনি মেইল পেয়েছেন। এ কারণে শহীদুল হাসান সাহেব আপনাকে বলতে বলেছেন। তিনি মেইল লিখতে লিখতে বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন। মেইলগুলো সেন্ড করে হঠাৎ ছেলেকে ডাকলেন। বুকের ব্যথার কথা বললেন। আমেরিকায় অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লাগে না। মুহূর্তে অ্যাম্বুলেন্স এলো। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। মানুষের মৃত্যুটা এত সহজ! মনটা এলোমেলো হয়ে গেল। চোখ হয়ে উঠল ঝাপসা। চুপ করে বসে থাকলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না একজন মানুষ আমাকে মেইল করেছেন তিনি ঢাকা আসছেন। আমি মেইল পড়ে উত্তর দেওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন। আহারে জীবন!

লন্ডনের জীবনে বাদশা ভাই ছিলেন গাফ্ফার ভাইয়ের ছায়াসঙ্গীর মতো। দুজন একসঙ্গে চলতেন। তাঁদের আলাদা করে ভাবতাম না। গাফ্ফার ভাই ইউরোপ যাবেন সঙ্গে বাদশা ভাই। ঢাকা আসবেন, কলকাতা যাবেন সবখানে বাদশা ভাই। ১৯৭৪ সালে ঢাকা ছেড়েছিলেন গাফ্ফার চৌধুরী। তাঁর কিছুদিন পর বাদশা ভাইও লন্ডন যান। ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর গাফ্ফার চৌধুরী কলম তুলে নেন। ১৯৭৬ সালে লন্ডন থেকে ‘বাংলার ডাক’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন তিনি। এ পত্রিকাটি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের প্রথম সংবাদপত্র। এম আর আখতার মুকুল, আবদুল মতিনও এ পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের স্ত্রী লায়লা চৌধুরী হাসিও কাজ করতেন এ কাগজে। বাংলার ডাক পত্রিকায় গাফ্ফার চৌধুরী প্রথম লিখলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আসল খুনি জিয়াউর রহমান’। এগুলো তখন লেখার কথা কেউ ভাবতেও পারত না। বছর দুই প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায় অর্থাভাবে। এরপর ‘প্রবাসী’ নামে আরেকটি পত্রিকা বের করলেন তিনি। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীও তখন লন্ডনে। তিনিও এ পত্রিকা অফিসে যেতেন। এরপর প্রকাশিত হয় ‘নতুন দিন’ পত্রিকাটি। এ পত্রিকার ১০ জন মালিকের একজন ছিলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। আরেকজন মালিক তারা মিয়া ছিলেন স্টার অব বোম্বে নামে এক রেস্টুরেন্টের অধিকারী। তিনি অর্থের ব্যবস্থা করে দেন ব্যাংক থেকে। ব্রিক লেনে নতুন দিনের অফিস ছিল। ঊর্মি রহমান, ঊর্মি মাজাহার, ড. শাফিউল্লাহসহ অনেকের আড্ডা হতো। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও বাদ যেতেন না। ড. শফিউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে স্থানীয়ভাবে জানাজা পড়াতে অস্বীকার করেন ব্রিক লেনের মৌলবিরা। গাফ্ফার চৌধুরী ছোটবেলায় মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। তিনি জানাজা পড়ালেন ড. শফিউল্লাহর।

সেই দুঃসময়ের কথা আজ হিসাব করলে হবে না। এখন দেশে সবাই আওয়ামী লীগ। এরশাদ জমানায় গাফ্ফার চৌধুরী নাটক লেখেন এরশাদ মারিয়াম নিয়ে। এতে অভিনয় করেন আবদুল মালেক উকিলের ছেলে খেলন। তিনি পরে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন এরশাদ সমর্থকদের হাতে। ’৭৫ সালের পর অনেক দিন ঢাকার পত্রিকাগুলো গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা প্রকাশ করত না। সে সময় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও এম আর আখতার মুকুল রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন। বিচারপতি মানিক ভাই বলেছেন, অর্থের অভাবে স্টার ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি নামে এক প্রতিষ্ঠানে এ দুজন মাছ কাটার কাজ করেছেন কিছুদিন। গাফ্ফার চৌধুরীকে নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। এই কিংবদন্তি সাংবাদিক স্বাধীনতার আগেই সংবাদপত্রে ইতিহাস গড়েছেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দাপুটে সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বেগবান করেছেন। আর ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর লড়েছেন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে। এখন গাছের পাতাও আওয়ামী লীগ করে। বঙ্গবন্ধু বলতে বলতে মুখে ফেনা তোলে। অথচ একদা গাফ্ফার চৌধুরীদের সংখ্যা সারা বাংলাদেশ মিলিয়ে খুব কম ছিল। সে বাস্তবতা আজ হয়তো আমরা ভুলে গেছি। গাফ্ফার ভাই নিজেই লিখে গেছেন, ‘আমি দীর্ঘ ৫০ বছর বিপদে-আপদে আওয়ামী লীগের পাশে রয়েছি। এখন হয়তো আওয়ামী লীগের আমার সমর্থনের আর কোনো প্রয়োজন নেই। এখন আওয়ামী লীগের হাজার হাজার সমর্থক। এই হাজার হাজার স্তাবক ও সমর্থকের ভিড়ে আমি হারিয়ে গেছি। সেজন্য আমার মনে কোনো দুঃখ নেই। যদি ডাক্তারদের ভবিষ্যদ্বাণী অসত্য প্রমাণ করে বেঁচে থাকি, তা হলেও আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানাব। তার ভুলত্রুটির সমালোচনা করব। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে যেন বিচ্যুত না হই- এই প্রার্থনা আমার। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিচ্যুত যে হাইব্রিড আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছে, তাকে প্রতিরোধের যুদ্ধে যেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত যুক্ত থাকতে পারি।’ গাফ্ফার ভাই চলে গেছেন। শেষ দিনটি পর্যন্ত লড়েছেন হাইব্রিডদের বিরুদ্ধে। তাঁর সেই লড়াইয়ের অবসান হয়নি। কোনো দিন হবে কি না জানি না।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন