ঋণের সুদের হার না কমানোর নতুন ফন্দি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য দফায় দফায় নির্দেশ দেয়া হলেও ব্যাংকগুলো তা কোনোক্রমেই মানছে না।

উল্টো ঋণের সুদের হার না কমিয়ে এখন আবার বাড়াতে শুরু করেছে। জুলাই মাসেও দুটি ব্যাংক নতুন করে ঋণের সুদের হার বাড়িয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে এই যখন অবস্থা, তখন এক অংকের সুদে ঋণ দেয়া তো দূরের কথা উল্টো একেবারে ঋণ না দেয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বেশিরভাগ ব্যাংক গোপনে ঐকমত্য হয়ে নতুন করে বড় অংকের মেয়াদি ঋণ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো প্রকাশ্যে এ অভিযোগ স্বীকার না করলেও বাস্তবতা হল অন্তত ২৭টি ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে কার্যকর করেছে। এজন্য কোনো কোনো ব্যাংক অজুহাত হিসেবে তাদের তীব্র তারল্য সংকটের বিষয়টিকে সামনে আনার চেষ্টা করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে সরকারপ্রধানের দুটি প্রতিশ্রুতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। একটি হল- সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন হবে না, অপরটি- বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থা আরও বেহাল হয়ে পড়বে। শিল্পায়নের গতি স্থবির হয়ে যাবে। কমে যাবে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার। সব মিলিয়ে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষতি ও ঝুঁকি নেমে আসবে।

প্রসঙ্গত, ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে চার দফা নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রীও নির্দেশনা দিয়েছেন ৬ দফা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানদের ডেকে একাধিকবার সুদের হার কমাতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ব্যাংকগুলো তা পালন করছে না।

অথচ সুদের হার কমানোর শর্তে ব্যাংকগুলোকে ৫ ধরনের বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। সেগুলো নিয়েও সুদের হার এক অংকে আনছেন না তারা।

সর্বশেষ গত সোমবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল সরকারি ব্যাংকগুলোর এমডি ও চেয়ারম্যানদের ডেকে ঋণের সুদের হার কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। গত রোববারও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ঋণের সুদের হার কমানোর জন্য আবারও সব ব্যাংকের এমডিদের নতুন করে নির্দেশ দিয়েছেন।

তারপরও সুদের হার কমানোর উদ্যোগ না নেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে একাধিকবার নির্দেশ দেয়ার পরও যখন সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামছে না; তখন স্বাভাবিকভাবে আবারও সেই প্রশ্ন সামনে চলে আসে যে, ‘সরকার বড়, নাকি ব্যাংক মালিকরা বড় হয়ে গেল?’ বাস্তবে একটি রাষ্ট্রে সরকারের চেয়ে কারও বেশি ক্ষমতায়ন বা ক্ষমতা থাকার সুযোগ নেই।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, জিডিপিতে সরকারি বিনিয়োগের অবদান মাত্র ৮ শতাংশ।

আর বেসরকারি বিনিয়োগের অবদান হচ্ছে ২৪ শতাংশ। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে।

সেদিকটি বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এর মধ্যে বড় শিল্পেই বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। কেননা বড় শিল্পে যেমন অনেকের কর্মসংস্থান হয়, তেমনি অর্থনীতিতেও এর ভূমিকা বিস্তৃত।

তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমলে বা ঋণের সুদের হার না কমালে দেশের শিল্পায়ন নির্ঘাত বাধাগ্রস্ত হবে। এতে আমদানির ওপর চাপ বাড়বে, রফতানি কমবে।

সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়বে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো তাদের মোট আমানতের ৮৩ শতাংশের বেশি এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো ৮৯ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করতে পারে না।

জরুরি প্রয়োজনে আমানতকারীদের অর্থ দেয়ার জন্য বাকি অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে বিধিবদ্ধ আমানত হিসেবে জমা রাখতে হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো ওই সীমার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল।

অভিযোগ রয়েছে, খারাপ গ্রাহকদের ঋণ দিতে গিয়ে এসব ঋণসীমা অতিক্রম করতে হয়েছে; যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকা ফেরত দেয় না, বিদেশে পাচার করে নিয়ে যায়।

ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে যারা বড় ধরনের জালিয়াতি করেছে তাদের জন্য আজ ব্যাংকগুলোর এ সংকট। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করেন, যারা ভালো গ্রাহক, তাদের কল্যাণে কার্যত কিছুই করা হয়নি।

সব সুবিধা দেয়া হচ্ছে ঋণখেলাপিদের জন্য। অথচ বছরের পর বছর যারা উচ্চ সুদও নিয়মিত পরিশোধ করে চলেছেন তাদের জন্য সরকার কোনো পলিসি দেয়নি। হিসাব করলে দেখা যাবে, ক্ষেত্রবিশেষে ভালো গ্রাহকের বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়।

এদিকে নির্ধারিত ঋণসীমা অতিক্রম করায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ওই সব ব্যাংকের ওপর কঠোর তদারকি আরোপ করা হয়। এছাড়া তাদের আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ ঋণ আমানত নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে।

বলা হচ্ছে, এজন্য ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩২টি ব্যাংক বড় অংকের ঋণ দিতে পারছিল না। এখন এ সংখ্যা ২৭টিতে নেমে এসেছে।

একই কারণে ব্যাংকগুলো এখন বড় অংকের ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। বাকি ৫টি ব্যাংক ইতিমধ্যে তা সমন্বয় করেছে। যেসব ব্যাংকের ঋণ আমানত ওই সীমার নিচে রয়েছে তাদের বড় অংকের ঋণ দিতে কোনো বাধা নেই। অবশিষ্ট ৩০টি ব্যাংকের ঋণ আমানত এখন ওই সীমার নিচে আছে।

ফলে এদের বড় অংকের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই ব্যাংকগুলোও এখন তারল্য সংকটের দোহাই দিয়ে বড় অংকের ঋণ দিতে চাচ্ছে না।

শুধু সরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক বড় অংকের ঋণ দিচ্ছে। অভিযোগ আছে, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মালিকরা নানা কৌশলে ব্যাংকের বড় অংকের আমানত সরিয়ে নিয়েছে। তারল্য সংকটের এটিই একটি অন্যতম কারণ।

মেয়াদি ঋণ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হালিম চৌধুরী  বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে সবাই একটু ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এ কারণে ঋণের গতিও ধীর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, অনেক ব্যাংক ২০১৭ সালে ঋণ আমানতের সীমার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করে ফেলেছে।

ফলে তারা ঋণ আদায় যেমন করতে পারছে না, তেমনি আমানতও বাড়াতে পারছে না। এজন্য তারা ঋণ আমানতের হার ওই সীমার মধ্যে নামাতেও পারছে না।

কোন কোন ব্যাংক মোট আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়ে ফেলেছে। এর ফলে বাড়তি ঋণ কলমানি থেকে ধার করে সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে মুদ্রা বাজারের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকে ঋণ আমানতের অনুপাত ১০০ ভাগের বেশি। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়ে ফেলেছে।

বিশ্লেষকরা ব্যাংকগুলোর এমন দুরবস্থার জন্য অভ্যন্তরীণ অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঋণ জালিয়াতিকে বেশি দায়ী করছেন। তাদের মতে, খারাপ গ্রাহকদের ঋণ না দিয়ে বেশি করে কম সুদে পরীক্ষিত ভালো গ্রাহকদের ঋণ দিলে আজ এমন সংকট তৈরি হতো না। এখনও যে পুঁজি আছে তা ভালো গ্রাহক ছাড়া অন্য কোথাও দেয়া ঠিক হবে না। সর্বোপরি যারা অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।