উপ্পলের গণপতি, হায়দরাবাদি হালিম ও কিঞ্চিৎ ক্রিকেট

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

হায়দরাবাদের পূর্ব শহরতলির উপ্পল এলাকার যে মাঠে বাংলাদেশ আর ভারতের টেস্ট ম্যাচ চলছে, সেই স্টেডিয়ামের চৌহদ্দির ভেতর, মূল প্রবেশপথের সামনেই রয়েছে একটা গণেশের মন্দির।  স্থানীয় লোকজন বলেন গণপতি। দুনিয়ার কোনও প্রান্তে কোনও ক্রিকেট মাঠে কখনও মন্দির-মসজিদ-চার্চ চোখে পড়েনি, কিন্তু হায়দরাবাদ এ দিক থেকে ব্যতিক্রম!

তো হায়দরাবাদ ক্রিকেট সংস্থার অতি প্রভাবশালী সচিব কে জন মনোজ রোজ এই মন্দিরে একবার কপাল ঠুকেই দফতরে ঢোকেন। নিজে গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টান হলে কী হবে, এই গণপতির আশীবার্দেই যে তাদের ক্রিকেট সংস্থার সিদ্ধিলাভ, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই তার। এমনকী, গত তিন-চার মাস ধরে লাগাতার খাটাখাটনির পর বাংলাদেশ টেস্টটা যে নির্বিঘ্নে করা যাচ্ছে, তিনি নিশ্চিত সেটাও এই গণপতির দয়াতেই!

তো শনিবার সকালে যখন সেই মন্দিরে মাথা ঠুকে জনসাহেব স্টেডিয়ামে ঢুকছেন, তাকে জিজ্ঞেস না-করে পারিনি ‘আজ কী চাইলেন গণেশের কাছে?’ একগাল হেসে জন মনোজ জবাব দিলেন, তিনি আজ মনেপ্রাণে চেয়েছেন বাংলাদেশ যেন সারাদিন খেলে। তাদের ব্যাটিং যেন হঠাৎ করে ধসে না পড়ে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ পুরো লড়াই দেওয়ার পর ম্যাচটা যেন সোমবার পঞ্চম দিনেও গড়ায়। যেন রবিবার ছুটির দিন স্টেডিয়ামটা ফুল হাউস থাকে!

আসলে ভারতে একটা নতুন ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সেরা বিজ্ঞাপন হলো তারা মাঠে কত লোক টানতে পারছে। ইদানীং টেস্ট ক্রিকেটে দর্শক সংখ্যায় ভাঁটার টান সারা দেশ জুড়েই–এমনকী কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সও তার ব্যতিক্রম নয়।

সেই জায়গায় হায়দরাবাদের উপ্পল যদি দেখিয়ে দিতে পারে তারা টেস্টেও মাঠে লোক টানার ক্ষমতা রাখে, টেস্ট ভেন্যু হিসেবে তাদের ইজ্জত বাড়বে অনেকগুণ। তাই প্রায় ৭০০ রানের পাহাড় ঘাড়ে নিয়েও বাংলাদেশ দাঁতে দাঁতে চেপে লড়াই দিক, কায়মনোবাক্যে এটাই প্রার্থনা হায়দরাবাদি ক্রিকেট কর্মকর্তাদের।

তা করলেনও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। সাকিব আল হাসান দারুণ এক ইনিংস খেলে আউট হয়ে গেছেন। তবে মুশফিকুর রহিম ও তরুণ মেহেদী হাসান মিরাজ চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। তৃতীয় দিনের শেষ সেশনটা নিজেদের করে নিয়ে অপেক্ষায় আছেন চতুর্থ দিনেও পারফরম্যান্সের ধারা সচল রাখার। আইপিএল খেলার সুবাদে সাকিবের আগে এ মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা আছে, দলের বাকি কারও সে সুযোগ হয়নি। উইকেট অচেনা হলেও একটু একটু করে কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন। মুশফিক-মিরাজের ব্যাটিংই তো সেটা বলে দেয়। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট, তার আগে মাত্র দু’দিনের একটা প্রস্তুতি ম্যাচ অবশ্যই এ শহরের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই যথেষ্ট ছিল না।

বাংলাদেশ দল যেমন উঠেছে শহরের অভিজাততম এলাকা বানজারা হিলসের খুব কাছে, হায়দরাবাদের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেল তাজ কৃষ্ণায়। ভারতীয় দলের ঠিকানাও একই।  কিন্তু সেই হোটেলের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে তারা শহরের চারমিনার এলাকার বিখ্যাত হালিম, বিরিয়ানি কিংবা কাবাব-পরোটার স্বাদ নিতে যাবেন, সেই সুযোগ এখনও কারও হয়েছে বলে শুনলাম না।

 

আধুনিক ক্রিকেটের জাঁতাকলে এ যুগের ক্রিকেটারদের এই বিলাসিতা দেখানো বোধহয় সম্ভবও নয়। একটা নতুন শহরে গিয়ে তারা সেখানকার স্থানীয় খাবারদাবার চাখবেন, চেটেপুটে খাবেন বিখ্যাত সব স্ট্রিট ফুড,  সে সব আজকাল স্বপ্নই রয়ে যায়, ডিনারে রুম সার্ভিস অর্ডার করেই তৃপ্তি মেটাতে হয় তাদের।

অথচ এই হালিম আর বিরিয়ানিই কিন্তু আশ্চর্যভাবে এ যাত্রায় হায়দরাবাদকে বাঁচিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশিদের শাপশাপান্ত থেকে। ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঢুকে-পড়া প্রথম টেস্ট কেন কলকাতায় না-হয়ে দক্ষিণ ভারতের হায়দরাবাদে হচ্ছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে মৃদুগুঞ্জন আর অনুযোগ শোনা যাচ্ছে, বেশ কিছুদিন ধরেই। কলকাতায় হলে অনেক বেশি দর্শক বাংলাদেশ থেকে আসতে পারতেন, টাকাপয়সাও অনেক কম খরচ হয়—এই নিয়ে তাদের আক্ষেপ একটা ছিলই। কিন্তু হায়দরাবাদে আসার পর এখানকার নিজামি খাবারদাবারে তাদের সে রাগ অনেকটাই জল!

আসলে ঢাকার যেমন আছে একটা পুরান ঢাকা, হায়দরাবাদেরও তেমন আছে একটা ওল্ড সিটি বা পুরান হায়দরাবাদ। পুরান ঢাকার মতোই স্বাদে-বৈচিত্র্যে সেই ওল্ড সিটির খাবারদাবারেরও কোনও জবাব নেই। দামেও যেমন সস্তা, স্বাদেও তেমনি তুখোড়। হায়দরাবাদি বিরিয়ানি অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে ঢাকার কাচ্চি বা ফখরুদ্দিনের সঙ্গে, আর কাবাব-হালিম টক্কর নিতে পারে লাহোরের। আর শহরের চারমিনার-ঘেঁষা সেই ওল্ড সিটির পরোটা-কাবাব-হালিমই আপাতত বাংলাদেশি দর্শকদের মেজাজমর্জি ঠিক রেখেছে।

হায়দরাবাদ টেস্ট বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারবে কিনা, এই উত্তর এখনও জানা নেই। জানা নেই জন মনোজের প্রার্থনা সত্যি করে স্টেডিয়ামের গণপতি ম্যাচটা পঞ্চম দিনে নিয়ে যাবেন কিনা।

কিন্তু ম্যাচের ফল শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক, স্মৃতিতে থেকে যাবে কাবাব আর কোহলি, হালিম আর রহিম!

সূত্র :  বাংলাট্রিবিউন