উজ্জীবনী মন্ত্রের জনসম্মোহনী নেতা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি নাগরিক যারা এখন বাংলাদেশে বসবাস করছেন তারা বড় সৌভাগ্যবান। সৌভাগব্যান এই অর্থে যে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তিতে সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছে এবং একই সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করছে। একই সময়ে এমন দুটি মহার্ঘ্য অনুষ্ঠান পালন করতে পারা নাগরিকদেরই আমি সৌভাগ্যবান বলছি।



১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বতন্ত্র জাতিসত্তা অর্জন করেছি, একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একদিনে সংঘটিত হয়নি। এর জন্য বাঙালির একটি দীর্ঘ প্রস্তুতি রয়েছে। ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ১৯৪০-এর দশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। এই সময় ভারত এবং অবিভক্ত বাংলা বিভক্ত হয়। মূলত অবিভক্ত বাংলা দ্বিখন্ডিত হওয়ার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্ট হয়েছিল। বিভক্তির পূর্ব লগ্নে ১৯৪৭ সালেই স্বাধীন এবং অবিভক্ত বাংলা রাষ্ট্র গড়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেটি তখন সফল হয়নি। সেই পরিকল্পনায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বীজ লুকায়িত ছিল। ১৯৪৭ সালে পরিকল্পিত এই জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ধারণার একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সৃষ্টির আগে থেকেই কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাঠামোয় বিশ্বাস ছিল না তার। তখন থেকেই তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি অর্জন করেন। তাই ঐতিহাসিকভাবে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলনে নেমেছিলেন সেই আন্দোলনের চেতনা তিনি ১৯৪৭ সালেই পেয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অনুপ্রেরণা তার ওই সময়েরই প্রাপ্তি। ওই সময়েই তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ বেশিদিন থাকবে না। এ কথা তিনি তখনই সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন। তাই এ কথা বলা যায় যে, দেশভাগের মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের সূত্র নিহিত ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সবসময়ই প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। তার এই চরিত্রটি বরাবরই আমরা দেখে এসেছি। তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন গণমানুষের জন্য। সাধারণ মানুষের দাবি ও অধিকারের প্রশ্নে তিনি সহজেই আন্দোলন গড়ে তুলতে পারতেন। এ বিষয়ে তার পারঙ্গমতা অসাধারণ। জনগণের মুক্তির জন্যই তিনি সবসময় আন্দোলন করেছেন। সূত্রপাতকাল থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান সরকার পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের প্রতি যে শোষণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে তা থেকে মুক্তির জন্য এদেশের জনগণকে তিনি উজ্জীবিত করেছেন।

মূলত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির দাবি আদায়ের সংগ্রামের সূত্রপাত। ভাষা আন্দোলনই বাঙালিকে পরবর্তী যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে প্রেরণা দিয়েছে। ভাষার দাবি রক্ত দিয়ে বাঙালি অর্জন করার পরে সব ধরনের আন্দোলন ও দাবি আদায়ের সংগ্রাম এক নতুন ধরনের মাত্রা পেয়েছিল। অর্থাৎ, ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সবসময় সাহস ও প্রেরণা দিয়ে এসেছে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের বাঙালি জনগণ তাদের আত্মবিকাশের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। বলাবাহুল্য, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির নেতৃত্বের বিকাশও শুরু হয়।

লক্ষণীয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের বিকাশও সামগ্রিকভাবে ভাষা আন্দোলনের (১৯৪৮-৫২) প্রেক্ষাপটেই শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাকালে বঙ্গবন্ধু যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে একটি জনআকাক্সক্ষার রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করেন। আমরা দেখি, ১৯৫০-এর দশকেই আওয়ামী লীগ যেভাবে জনগণের কাছে পৌঁছেছিল সেটি ছিল অভাবনীয়। বঙ্গবন্ধুর প্রায় একক প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ জনগণের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজনৈতিক দল জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ধারণের সক্ষমতা এই সময় থেকেই অর্জন করতে শুরু করে। এভাবে নানা ঘটনা পরম্পরায় বঙ্গবন্ধু জনগণের নেতৃত্বে আসেন। জনগণের অধিকার আদায়ের নানা ইস্যু এবং পরিপ্রেক্ষিত মুজিবকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে জনগণের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভাগ্য বদলের সবচেয়ে বড় কৃত্যকারক।

১৯৭২ সালে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি চয়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৫০-এর দশক থেকে জনগণের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে, জনগণের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে তার চেতনায় যে আদর্শবোধ সৃষ্ট হয় তারই নির্যাস হলো এই রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিচতুষ্টয়। জনগণকে এসবের সঙ্গে পরিচিত করাতে বঙ্গবন্ধু নিরলসভাবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু নিজের জনসম্মোহনী নেতৃত্ব দিয়ে জনগণকে উজ্জীবিত করেছেন। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদী জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এইভাবে জনগণের আকাক্সক্ষা সঞ্জাত নীতিপদ্ধতিগুলো সুনির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতিতে পরিণত হয়েছে।

আমরা দেখব পঞ্চাশের দশকেই বঙ্গবন্ধুর চেতনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধারণা সঞ্চারিত হতে শুরু করে। তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ববঙ্গ এবং বাঙালির স্বাতন্ত্র্যের কথা বলেছিলেন। পাকিস্তানের কাঠামোর বাইরে যে বাঙালিত্বের চেতনা সেই পঞ্চাশের দশকেই শেখ মুজিব এসব নিয়ে সরব ছিলেন। ১৯৬১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে গোপন বৈঠক করেছিলেন সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে পূর্ববঙ্গের (পূর্ব পাকিস্তানের) স্বাধীনতার কথা তুলেছিলেন। আবার ১৯৬২-তে তিনি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের আগরতলায় গিয়েছিলেন দেশের পরিকল্পিত স্বাধীনতা অর্জনে এই বৃহৎ প্রতিবেশীর সহায়তার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধারণাটি তিনিই প্রথম গণমানুষের সামনে তুলে ধরেন। ১৯৬৬ সালের ৬-দফা তো ছিল বাংলাদেশের অগ্রিম জন্মসনদের মতো। বস্তুতপক্ষে ৬-দফার পরবর্তী ধাপই ছিল এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬-দফা ঘোষণার পর রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপচারিতায় এমনই ইঙ্গিত দেন। প্রকৃতপক্ষে, ছয়-দফা কেবল দাবি বা অধিকার আদায়ের কর্মসূচিই ছিল না, এটি মূলত বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা ও স্বাধীন করার এক মন্ত্র ছিল। এই কর্মসূচির মধ্যে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অর্থনীতির ধারণাও প্রস্ফুটিত হয়। বঙ্গবন্ধু বিপ্লবী ছিলেন না। তিনি বামপন্থি ছিলেন না। তিনি ছিলেন উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদী। তিনি ছয়-দফার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করে একটি জাতিকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। তার ইতিহাসজ্ঞান সবসময়ই প্রখর ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চাইবে না। তাই তিনি ধীরে ধীরে পুরো জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রস্তুত করে তোলেন। সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে এগিয়ে যান। কিন্তু পাকিস্তানিরা তা হতে দেয়নি। এটা যে হতে দেওয়া হবে না, নিজের সহজাত ইতিহাসজ্ঞান থেকে তিনি তা মনেও করতেন। এর অবশ্যম্ভাবী পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন। তার স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি মরণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ অর্জন করে।

সেই বাংলাদেশ আজ তার বিজয়ের ৫০ বছরপূর্তি অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে চলেছে। একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে নতুন দেশটির যে যাত্রা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে তার উল্টোযাত্রা শুরু হয়। ইতিহাসের সম্মুখবর্তী অগ্রযাত্রাকে পশ্চাৎমুখী করা হয়। যে ইতিহাস ও চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশ সেখান থেকে সরে যায়।

তবে এ কথাও সত্য যে, ইতিহাস কখনো পেছনমুখী হয় না। জনগণের নিত্যনতুন আকাক্সক্ষা ধারণ করে প্রগতির পতাকা বহন করে ইতিহাস সামনে এগিয়ে যাবেই। সেটাই হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। দীর্ঘ সময় পরে সেটির যাত্রা শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে প্রথমে ১৯৯৬ সালে এবং পরে ২০০৯-এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উন্নয়ন-অগ্রগতিতে সক্ষমতা অর্জন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের যৌথ উদযাপনের এই মাহেন্দ্রক্ষণ বাংলাদেশ এবং এদেশের নাগরিকদের জন্য পরম সৌভাগ্যের।

লেখক সাবেক সভাপতি ও অধ্যাপক ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: দেশ রূপান্তর