উচ্চ সুদ নিয়ে আপত্তি অর্থ মন্ত্রণালয়ের

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: 

উচ্চ সুদে ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আমদানি করা হচ্ছে জ্বালানি তেল। সুদের হার ধরা হয়েছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সম্প্রতি জেদ্দায় ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্সের (আইটিএফসি) সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল চুক্তিটি সম্পন্ন করেছে। কিন্তু সুদের হার বেশি থাকায় এ ঋণ চুক্তি নিয়ে আপত্তি তুলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ‘অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটি’ এ চুক্তির অনুমোদন না দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে সুদের হার আরও কমিয়ে আনাসহ তিনটি বিষয়ে মত দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

এদিকে ঋণটির অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ফের অর্থ সচিবকে ৯ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আকরাম আল হোসেন। চিঠিতে আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ে জাহাজে ক্রুড অয়েল উত্তোলন সম্ভব না হলে তেল আমদানিতে বিলম্ব হতে পারে। এতে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডকেও শাটডাউনে যেতে হতে পারে। আর এটি হলে শেষ পর্যন্ত জ্বালানি তেলের সংকট সৃষ্টি হবে। এতে নিরবচ্ছিন্নভাবে সারা দেশে সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে।

জানতে চাইলে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার সোমবার যুগান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেল আমদানির ঋণ চুক্তি নিয়ে বিপিসির দেয়া চিঠির বিষয়ে এখনও আমি অবহিত নই। বিষয়টি এখনও আমার নজরে আসেনি। মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে আসতে পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন।

জানা গেছে, দেশে জ্বালানি তেলের মোট চাহিদা ৫৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডিজেল ৩৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, কেরোসিন আড়াই লাখ, অকটেন দেড় লাখ এবং পেট্রল ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন।

জ্বালানি ও খনিজ বিভাগ সূত্র মতে, আগামী ২০১৯ সালের জন্য দেশের মোট জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানে ঋণ গ্রহণের একটি সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়। সেখানে ঋণ সহায়তার জন্য জেদ্দাস্থ আইটিএফসির সহায়তা নেয়ার কথা বলা হয়। সে লক্ষ্যে চলতি বছরের ১০-১২ জুলাই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল জেদ্দায় গিয়ে আইটিএফসির সঙ্গে বৈঠক করে। ওই বৈঠকে অর্থ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিপিসির প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে আলোচনা শেষে আগামী বছরের জন্য ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে একশ’ কোটি মার্কিন ডলার বা ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার (প্রতি ডলার সমান প্রায় ৮৪ টাকা) ঋণ চুক্তি সম্পন্ন করে প্রতিনিধি দলটি।

জানা গেছে, সম্প্রতি এ ঋণ চুক্তি সরকারের ‘অনমনীয় ঋণ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির’ কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু উচ্চ সুদে এ ঋণ নেয়ায় আপত্তি জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। ঋণ চুক্তির অনুমোদন না দিয়ে তিনটি মত দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। ঋণসংক্রান্ত বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় মতামতে বলেছে, ‘স্বল্পমেয়াদি তথা ছয় মাস মেয়াদি ঋণের বিপরীতে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সুদের হার অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি, এটা আলোচনার মাধ্যমে আরও কমিয়ে আনা আবশ্যক।’ সেখানে আরও বলা হয়, ‘একক উৎস পরিহার করে জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যে অর্থায়নের জন্য আরও বিকল্প উৎস সন্ধানে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়কে তৎপর হতে হবে।’ সর্বশেষ মতে বলা হয়, ‘এ আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে দেশীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।’

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ মতের পরিপ্রেক্ষিতে বিপিসি থেকে একটি ব্যাখ্যাসহ চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে বিপিসি বলেছে, সবার উপস্থিতিতে এ ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত অনুযায়ী এ পর্যায়ে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সুদ থেকে কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। কারণ আইটিএফসির ঋণ তাদের সদস্যভুক্ত অন্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ নির্ধারণ করা আছে। এছাড়া ঋণটি পরিবর্তনীয় হারে গ্রহণের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। এরপরও নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এক বছরের জন্য সুদ হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে চুক্তি করা হয়। এটি দেশের জন্য সবচেয়ে ভালো সুদের রেট।

ওই চিঠিতে বলা হয়, এ ধরনের ঋণ চুক্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আইটিএফসির পাশাপাশি অন্যান্য বিকল্প উৎস খোঁজ করতে নেগোসিয়েশন প্রতিনিধি দলও পরামর্শ দিয়েছে। ফলে বিকল্প উৎস খুঁজতে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।

বিপিসির চিঠিতে আরও বলা হয়, আইটিএফসি জেদ্দার অর্থায়নে বাংলাদেশ ক্রুড জ্বালানি তেল আমদানি করে। বর্তমান বিশ্ববাজারে তেলের দাম ক্রমেই বাড়ছে। বিপিসি মূলত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ক্রুড তেল আমদানি করে থাকে। ক্রুড জ্বালানি তেল আমদানির জন্য নগদ বৈদেশিক মুদ্রার আওতায় এলসিগুলো খোলা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে নগদ মুদ্রায় এলসি খোলা হবে সৌদি আরব বা ইইউর বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে (থার্ড ব্যাংক)। এছাড়া এলসি খোলার পর পুনরায় এড-কনফার্ম করতে হয়। কিন্তু এড-কনফার্ম চার্জ এলসি কমিশনের প্রায় কয়েকগুণ। এতে সময়ের প্রয়োজনও হয়। পাশাপাশি লিফটিং লোকশন সময়ের মধ্যে জাহাজে ক্রুড অয়েল উত্তোলন সম্ভব হয় না। এতে তেল উত্তোলন বিলম্ব হলে প্রতিদিনের জন্য লোডপোর্টে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন ডলার বা ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে। তবে আইটিএফসির ঋণের আওতায় এলসি খোলা হলে তারা থার্ড ব্যাংকের কনফার্ম কাজটি করে দেয়। এতে ক্ষতিপূরণ ও লোকশনের আশঙ্কা থাকে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিপুল অঙ্কের এ ঋণটি অনুমোদন নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে। কারণ উচ্চ সুদে ছয় মাসের জন্য ঋণটি নেয়া হলে বড় ধরনের অর্থ গুনতে হবে অর্থ বিভাগকে। যে কারণে বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে।