বৃহস্পতিবার , ৪ জুলাই ২০২৪ | ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনের গণহত্যা বন্ধ হবে কবে?

Paris
জুলাই ৪, ২০২৪ ৮:৪৩ অপরাহ্ণ

।। শহিদুল ইসলাম কবির ।।

৫ জুলাই ২০০৯। চীনের জিনজিয়াংয়ের রাজধানী উরুমকিতে চীনা সরকারের হামলায় ১৯৭ জন নিহত ও এক হাজার ৭২১ জন আহত হন। দুই উইঘুর হত্যার প্রতিবাদে হাজারও মানুষ বিক্ষোভে নামে। সেখানে চীনা সরকার তাদের ওপর হামলা চালায়। এরপর উইঘুর পরিচালিত মসজিদগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় ৪০০ জনেরও বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়। তাদের ৯ জনকে মৃত্যৃদণ্ড দেয়া হয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে কমপক্ষে ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আঞ্চলিক রাজধানী উরুমচিতে এই দাঙ্গা শুরু হয়। জাতিগত ভবেহ্যান জনগোষ্ঠীর আধিপত্যের কারণে সৃষ্ট হতাশা থেকে ওই ঘটনা ঘটার কথা বলা হয়েছে। চীনের দক্ষিণাঞ্চলে গুয়াংদং প্রদেশে উইগুরদের সাথে হ্যান চীনাদের এক সংঘর্ষের জের ধরে এই সহিংসতা ঘটে। শিনজিয়াংয়ের ছয়জন ছেলে দুজননিরীহ মেয়েকে ধর্ষণ করেছে -এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শাওগুয়ান শহরে একটি কারখানায় হ্যানদের সাথে উইগুরদের মারামারি হয়। এতে দুইজন উইগুর নিহত হয়। উরুমচিতে প্রতিবাদকারীরা ঐ ঘটনার তদন্ত দাবি করছিল। শিনজিয়াংয়ে প্রায় ৮০ লাখ উইগুর বসবাস করে। তারা মুসলমান, এবং কিছু উইগুর চীন থেকে আলাদা হয়ে যেতে চায়। নির্যাতিত উইঘুর মুসলিমদের ইতিহাস: বর্তমানে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নাম উইঘুর। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে থাকা এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো নির্যাতনের দৃশ্য প্রকাশ পায় না গণমাধ্যমেও। যদিও এক সময়‘পূর্ব তুর্কিস্থান’নামে স্বাধীন একটি দেশ ছিল তাদের। যা বর্তমানে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। উইঘুররা মূলত তুর্কি বংশোদ্ভূত এবং তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর অর্ন্তগত উইঘুর ভাষায় কথা বলে থাকেন। তাদের বর্ণমালা আরবি হরফে লিখা হয়। যদিও নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষার ওপর দখলদারিত্ব বজায় রাখতে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে অঞ্চলটির মুসলিমদের। ১৮৮৪ সালে চীনের মাঞ্চু রাজবংশের সঙ্গে দীর্ঘ আট বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা হারায় পূর্ব তুর্কিস্থান। তারপরই অঞ্চলটির নামকরণ করা হয় জিনজিয়াং। চীনের কাছে স্বাধীনতা হারানোর পর উইঘুররা একে একে হারাতে থাকে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। ১৯১১ সালে মাঞ্চু সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ১৯৩৩-৪৪ সালে দুবার স্বাধীনতা লাভ করে উইঘুররা। এসময়পূর্ব তুর্কিস্থান রিপাবলিক নামে একটি স্বাধীন দেশ গঠন করা হয়। তবে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর বামপন্থি সেনাদের অভিযানে আবারও স্বাধীনতা হারায় উইঘুররা। বর্তমানে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলটিতে বাড়ছে চীনের হান জনগোষ্ঠীর বসবাস। মূলত মুসলিমদের সংখ্যালঘু করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেখানে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে চীন সরকার। ১৯৪৯ সালে পূর্ব তুর্কিস্থানে উইঘুর মুসলিমদের সংখ্যাছিল ৯৫ শতাংশ, ১৯৮০ সালেরমধ্যেইতা ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। বর্তমানে নিজেদের ভূখন্ডে উইঘুরদের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ। চীনের দখলে যাওয়ার পর থেকেই পূর্ব তুকিস্থান তথা জিনজিয়াংয়ে মুসলিমদের নিধন করতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করে কমিউনিস্ট সরকার। ১৯৯০ সালে সেখানে এক ভয়াবহ দাঙ্গা উস্কে দেয় চীন সরকার। পরে দাঙ্গার অভিযোগে গ্রেপ্তার ও হত্যা করা হয় কয়েক হাজার উইঘুর যুবকদের। সেই থেকে এখন পর্যন্ত উইঘুরদের দমনে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে চীন। পরিবারের অধিকাংশ পুরুষকেই রাখা হয় পুনঃশিক্ষা কেন্দ্রে। সেখানে মুসলিম পরিচয় মুছে দিয়ে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় চীনা জাতীয়তাবাদ। নারীদের আটকে রেখে চালানো হয় নানা ধরনের নির্যাতন। নির্যাতন থেকে বাঁচতে কেউ পালিয়ে গেলে পরিবারেরও পর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। শিশুদের পিতা-মাতা থেকে আলাদা করে পাঠানো হয় বিভিন্ন ক্যাম্পে। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশটির সন্ত্রাসবিরোধী বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে ১০ লাখের বেশি উইঘুর নাগরিককে। উইঘুরদের মধ্যে চীনা জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে মেকিংফ্যামিলি নামে একটি ঘৃণ্য ও অভিনব পদ্ধতি চালু করে চীন। এর আওতায় উইঘুর পরিবারগুলোতে প্রতিমাসে কয়েক দিন অতিথি হয়ে থাকেন হান পুরুষরা। এ সময় পরিবারের নারীদের বাধ্য করা হয় এসব চীনা পুরুষদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে। শিক্ষা দেয়া হয় চীনা জাতীয়তাবাদ ও কমিউনিস্ট আদর্শ। ১৭ নভেম্বর ২০২৩। ‘উইঘুর সংস্কৃতি মুছে দিতে’বদলে ফেলা হচ্ছে তাদের গ্রামের নাম। চীনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে উইঘুর মুসলমানদের সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে দেশটির জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুরদের কয়েক হাজার গ্রামের নাম বদলে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

সম্প্রতি প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের ধর্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে রাখা কয়েক হাজার গ্রামের নাম বদলে দেয়া হয়েছে। যেমন বিভিন্ন জায়গার নাম থেকে ‘সুলতান’বা‘শ্রিন’ (মাজার) বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই স্থানে খুশি বা সম্প্রীতি প্রকাশ করে, এমন সব শব্দে নাম রাখা হয়েছে। চীন সরকারের প্রকাশ করা তথ্য বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলে জানায় বিবিসি। এ অভিযোগ নিয়ে জানতে বিবিসি লন্ডনে চীনা দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। উইঘুর মুসলিমদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে বের করে চীনের মূলস্রোতের সঙ্গে সংযুক্ত করতে গত কয়েক বছরে চীনা প্রশাসন থেকে জিনজিয়াংয়ে ব্যাপক জোর জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে যে ব্যবস্থাকে নির্যাতন বলা হয়ে থাকে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিশ্লেষকরা চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের ওয়েব সাইটে ঢুকে গত ১৪ বছরে জিনজিয়াং অঞ্চলের গ্রামগুলোর নাম পরিবর্তনের বিষয়টি লক্ষ করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, ওই অঞ্চলে প্রায় ২৫ হাজার গ্রামের মধ্যে ৩ হাজার ৬০০টি গ্রামের নাম বদলে ফেলা হয়েছে। যে নামগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ছিল জাতিগত। প্রায় এক পঞ্চমাংশ নাম ছিল উইঘুরদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। চীনে প্রায় দুই কোটি মুসলমানের বসবাস। আনুষ্ঠানিকভাবে চীন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। চীন সরকার সব সময় দাবি করে, সে দেশে যার যার ধর্ম পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তবে সরকার যতই দাবি করুক, গত কয়েক বছরে দেশটিতে ধর্মভিত্তিক দমন-পীড়ন বেড়ে গেছে। বিবিসি। প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৪ উইঘুর মুসলিমদের নিপীড়নের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে: জাতিসংঘ: জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনের মারাত্মক নিপীড়নের‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ’পাওয়া গেছে। এসব তথ্য প্রমাণ সম্ভাব্য ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’সংঘটনের পর্যায়ে পড়ে। জাতিসংঘের বহুল প্রতীক্ষিত এক প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়েছে। খবর বিবিসির। প্রতিবেদনটি প্রকাশনা করার আহ্বান জানিয়েছিল চীন। বেইজিং প্রতিবেদনটিকে পশ্চিমা শক্তিগুলোর‘প্রহসনের আয়োজন’বলেও মন্তব্য করেছে। প্রতিবেদনে উইঘুর মুসলিম ও অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ পর্যালোচনা করা হয়েছে। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে চীন। তবে তদন্তকারীরা বলছেন, তাঁরা নিপীড়নের‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ’উদ্ঘাটন করেছেন, যা সম্ভাব্য ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’সংঘটনের পর্যায়ে পড়ে। তাঁরা অভিযোগ করেন, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ করতে চীন অস্পষ্ট জাতীয় নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করছে এবং‘বিধিবহির্ভূত আটকের ব্যবস্থা’প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের কার্যালয় এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। হাইকমিশনার হিসেবে তাঁর চার বছর দায়িত্ব পালনের শেষ কর্মদিবসে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, যে․ন ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যসহ বন্দীরা বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। অন্যদের ওপর বৈষম্যমূলক পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তাঁরা দাবি করেছেন। জাতিসংঘের সুপারিশে বলা হয়েছে, চীন অবিলম্বে যেন‘বিধিবহির্ভূতভাবে স্বাধীনতাবঞ্চিত সব ব্যক্তিকে’ মুক্তি দেয়ার জন্য পদক্ষেপ নেয়। বেইজিংয়ের কিছু কর্মকাণ্ড‘কমিশনের কাছে মানবতাবিরোধী অপরাধসহ আন্তর্জাতিক অপরাধের’পর্যায়ে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে জাতিসংঘ জানিয়েছে, কত মানুষকে সরকার আটক করেছে, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নয়। চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ের শিবিরগুলোয় ১০ লাখের বেশি মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে বলে ধারণা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি উইঘুরের বসবাস, যাদের অধিকাংশই মুসলিম। সেখানকার অমুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে বলে প্রতিবেদনে বলেছে জাতিসংঘ। এরআগে জিনজিয়াংয়ে চীনের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা বলে অভিহিত করে কয়েকটি দেশ। তবে বেইজিং নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা বলছে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলারই অংশ এসব বন্দিশিবির।

০১ সেপ্টেম্বর ২০২২। উইঘুর অঞ্চলের জনঘনত্ব কমানোর চীনা কৌশল : চীনের জিনজিয়ান অঞ্চলের জনমিতি বদলে দিতে চায় দেশটির সরকার। এই লক্ষ্যের অংশ হিসেবে তারা ব্যাপকভিত্তিক কর্মপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মপ্রকল্প জিনজিয়ানে সংখ্যালঘু মুসলিম উইঘুর সম্প্রদায়ের জনঘনত্ব কমাচ্ছে। উচ্চপর্যায়ের একটি গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানানো হয়। চীনা গবেষণাটি বিবিসির দেখার সুযোগ হয়েছে। সেই গবেষণার তথ্যের আলোকে বিবিসির খবরে বলা হয়, উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজারো মানুষকে অন্যত্র স্থানান্তরের একটি নীতি বাস্তবায়ন করছে চীন সরকার। ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানপ্রকল্পের আওতায় লোকজনকে জিনজিয়ান থেকে দূরের স্থানে স্থানান্তর করা হচ্ছে। ফলে জিনজিয়ানে তাদের লোকসংখ্যা কমছে। তবে জিনজিয়ান অঞ্চলের জনমিতি বদলে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করছে চীন সরকার। তাদের ভাষ্য, লোকজনের আয় বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী গ্রামীণ বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে জিনজিয়ান থেকে লোকজনকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হচ্ছে। বিবিসি বলছে, চীন সরকারের দাবির বিপরীতে তথ্য-প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে, কর্মপ্রকল্পের ওই নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জিনজিয়ানের সংখ্যালঘুদের জীবনযাপন ও চিন্তাভাবনা বদলে দিতে কর্তৃপক্ষের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের মিল রয়েছে। কর্মপ্রকল্পের এই নীতিটি জোর জবরদস্তিমূলক। উইঘুরসহ অন্য সংখ্যালঘুদের জন্য জিনজিয়ানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক‘পুনঃশিক্ষণ’শিবির তৈরি করা হয়েছে। এসব শিবিরে মগজধোলাই থেকে শুরু করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে। বিবিসি বলছে, ২০১৭ সালের দিকে জিনজিয়ান থেকে শ্রম স্থানান্তরের নীতিটি জোরদার হতে শুরু করে। এ নিয়ে তখন চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রচার করা হয়। ভিডিও প্রতিবেদনে জিনজিয়ান থেকে লোকজনকে অন্যত্র চাকরির জন্য নেয়ার বিষয়টি উঠে আসে। পুরোনো সেই ভিডিও প্রতিবেদনেই স্পষ্ট যে জিনজিয়ানের লোকজন চাকরির জন্য স্বেচ্ছায় অন্যত্র যেতে ইচ্ছুক নন। তাঁরা জবরদস্তির মুখে অন্যত্র যেতে বাধ্য হন। ভিডিওটিতে জিনজিয়ানের এক নারীকে চাকরির জন্য অন্যত্র যেতে বারবার জোর করতে দেখা যায়। চাপের মুখে এক পর্যায়ে ওই নারী বলেন, ‘আমি যাব, যদি অন্যরা যায়।’ভিডিওর শেষে দেখা যায়, চাকরির জন্য ওই নারীসহ অন্যরা নিজেদের পরিবার ও সংস্কৃতি ছেড়ে দূরে কোথাও যাচ্ছেন। তাঁদের বিদায়বেলায় সেখানে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লরামারফি বলেন, এই সব প্রকল্পে লোকজন স্বেচ্ছায় অংশ নেয় বলে দাবি করে আসছে চীন সরকার। কিন্তু স্পষ্ট হয়েছে যে এটা জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় লোকজনের দ্বিমত করার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠন অভিযোগ করে আসছে, উইঘুরসহ অন্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চীন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করছে।

০৩ মার্চ ২০২১। চীনে মসজিদ ভেঙে ফেলানিয়েপুলিশের সাথে মুসলিমদের সংঘর্ষ: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা ভিডিওতে দেখা যায়, ইউনানের নাগু শহরে ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত নাজিয়াইং মসজিদের বাইরে অনেক মুসলিম জড়ো হয়েছেন। এ সময় পুলিশ ও স্থানীয় মুসলিমদের মাঝে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশের সশস্ত্র শতাধিক কর্মকর্তা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। জাতিগত দিক থেকে বৈচিত্র্যময় চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রদেশ ইউনানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। সরকারি ভাবে নাস্তিক রাষ্ট্র হলেও চীনে ধর্মীয় স্বাধীনতার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে সংগঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে নিপীড়ন বেড়েছে। একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চাইছে বেইজিং। নাগুরনাজিয়াইং মসজিদটি মুসলিমদের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। গত কয়েক বছরে এই মসজিদের গম্বুজযুক্ত ছাদ ও কয়েকটি মিনার নির্মাণসহ এর আকার বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালে দেশটির একটি আদালত মসজিদটির সম্প্রসারণ কাজকে অবৈধ ঘোষণা করে তা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। সম্প্রতি মসজিদটির গম্বুজও সম্প্রসারিত অংশ ভেঙে ফেলার উদ্যোগ আদালতের ওই আদেশ কার্যকর করার জন্য নেয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সেখানকার মুসলিমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভের ভিডিওগুলোর সত্যতা যাচাই করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশের সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মুসলিমদের মসজিদে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এ সময় অনেকে জোর করে মসজিদে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এছাড়া মসজিদে প্রবেশে বাধা দেওয়ায় বিক্ষোভকারীদের একটি দল পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়েছে। অন্য কয়েকটি ভিডিওতে পুলিশকে পরবর্তীতে মসজিদের সামনে থেকে চলে যেতে দেখা যায়। পরে সেখানে বিক্ষোভকারী মুসলিমরা মসজিদটিতে প্রবেশ করেন। ইউনানের টংহাইকাউন্টির পুলিশ এক বিবৃতিতে বিক্ষোভকারীদের পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছে। বিক্ষোভে জড়িত সন্দেহে কয়েকডজন মুসলিমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বেইজিংয়ের স্বীকৃত ৫৬টি জাতিগত গোষ্ঠীর একটি হুই। আর এই হুই সম্প্রদায়ের সদস্যরা সুন্নিপন্থী মুসলিম। চীনজুড়ে প্রায় এক কোটি হুই মুসলিম রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজারই দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমের ইউনানে বসবাস করেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের ধর্মীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর অধিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করছে বেইজিং। সূত্র: বিবিসি।

৩০ মে ২০২৩ অন্য গোত্রে বিয়ে করতে জোর করা হচ্ছে উইঘুর নারীদেরকে : উইঘুরদের নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা উইঘুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্ট (ইউএইচআরপি) জানিয়েছে এ তথ্য। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে উইঘুর নারীদের অন্য গোত্রে বিয়ে করতে জোর করা হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এটি অনেকাংশে বেড়েছে। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম, নীতি এবং নথি, সরকারি কাগজপত্র এবং উইঘুর নারীদের তথ্য যাছাই-বাছাই করে এ তথ্য প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্থাটি। ‘উইঘুরনারীদের জোরপূর্বক বিবাহ: পূর্ব তুর্কিস্থানে আন্তঃজাতি বিবাহে সরকারি নীতি’শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব তুর্কিস্থানের হ্যান পুরুষদের সঙ্গে উইঘুর নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ার অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হয়েছে। এই তদন্তে দেখা গেছে, চীনের সরকার প্রত্যক্ষভাবে উইঘুর নারীদের হ্যান চাইনিজ পুরুষদের সঙ্গে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে আত্মীকরণে বাধ্য করছে। ইউএইচআরপির প্রধাননির্বাহী ওমর কানাত বলেছেন, এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আরেকটি লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার বিষয় সামনে আসল। এ সহিংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ওয়াশিংটনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, উইঘুর নারীদের সঙ্গে যা করা হচ্ছে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল।

১৮ নভেম্বর ২০২২ চীনে উইঘুর মুসলিম বন্দি শিবিরের ভয়াবহ তথ্য ফাঁস: নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা এ ধরনের অনেক নথিতে দেখা গেছে, দেশটির সংখ্যালঘু উইঘুর এবং টার্কিক সম্প্রদায়ের মানুষদের ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের কোনোরকম চিহ্ন দেখা গেলে তাদের দীর্ঘ কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে। ওই এলাকার পুলিশের কম্পিউটার সার্ভার হ্যাক করে জোগাড় করা বিশাল এই তথ্য ভাণ্ডারে রয়েছে, শিনজিয়াং এর চূড়ান্ত গোপনীয়তায় ঢাকা পদ্ধতির একেবারে কেন্দ্রে থাকা হাজার হাজার ছবি এবং আটক কেন্দ্র থেকে পালানোর চেষ্টা করলেই গুলি চালিয়ে হত্যার নীতি বিষয়ক নানা সাক্ষ্যপ্রমাণ। ফাঁস হওয়া কিছু কিছু ছবিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দেখা যাচ্ছে, বন্দীদের মাথায় কালো হুড এবং শরীরে শেকল বেঁধে নতি স্বীকারে বাধ্য করার কে․শল প্রয়োগ করতে। ‘জিনজিয়াং পুলিশ ফাইল’নামে পরিচিত এসব নথি বিবিসির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের গোড়ার দিকে। গত কয়েক মাস ধরে এসব নথির সত্যতা যাচাই ও অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে এসেছে ওই এলাকায় উইঘুর এবং টার্কিক সম্প্রদায়ের মানুষদের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে কোনোরকম চিহ্ন দেখলেই তাদের বন্দি করার প্রক্রিয়া নিয়ে ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য। ২৪ মে ২০২২। চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উইঘুরদের মামলা: মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। তুরস্কের আইনজীবী গুলদেনসন মেজ জানিয়েছেন, সংখ্যালঘু উইঘুর জনগোষ্ঠীসহ সংখ্যালঘু অন্য আরও মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ লাখ মানুষকে ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটকে রেখেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। সেখানে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক শ্রম আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর এই অভিযোগ সামনে আসার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চীনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি। আর এ কারণেই অভিযুক্ত চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করার প্রয়োজন ছিল। চীন অবশ্য বরাবরই এ ধরনের বন্দিশিবিরের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে একপর্যায়ে এগুলোকে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে চীন দাবি করে, উগ্রবাদ দূর করতে সেখানে উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া উইঘুরদের ওপর গণহত্যার অভিযোগ অযৌক্তিক, হাস্যকর এবং ডাহামিথ্যা বলেও দাবি করে থাকে বেইজিং। তুরস্কে প্রায় ৫০ হাজার উইঘুর বসবাস করে। মধ্য এশিয়ার বাইরে এককভাবে কেবল তুর্কি ভূখন্ডেই এতোসংখ্যক উইঘুর মুসলিমের বাস রয়েছে। আল জাজিরা বলছে, ইস্তাম্বুলের প্রধান প্রসিউটরের কার্যালয়ে চীনের ১১২ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন ১৯ জন উইঘুর সদস্য। ইস্তাম্বুলের প্রধান আদালতের বাইরে আইনজীবী গুলদেনসন মেজ জানান, ‘এই মামলার বিচার কাজ আরও আগেই শুরু করা উচিত ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের। কিন্তু চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং এ কারণে এই পন্থায় বিচার সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।’এসময় ইস্তাম্বুলের ওই আদালতের সামনে আইনজীবীকে ঘিরে পতাকা ও প্লেকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিলেন অর্ধশতাধিক নারী ও পুরুষ। তারা সবাই তাদের পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের ছবি হাতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আর তাদের হাতে থাকা প্লেকার্ডে অভিযুক্ত চীনা কর্মকর্তাদের বিচারের দাবি জানানো হয়। এর আগে গত ডিসেম্বরে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে চীনকে অভিযুক্ত করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি অনানুষ্ঠানিক স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। সেসময় চীনের বিরুদ্ধে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ে বলা হয়, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন ও নিপীড়ন চালানোর মানসিকতা থেকেই চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর জন্ম নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য বাধ্যতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ চাপিয়ে দিচ্ছে। চীনা কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপকে কার্যত গণহত্যা হিসেবেই উল্লেখ করেন তারা। এর আগে গত বছরের মার্চে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদনে জিনজিয়াংয়ে চীনা নিপীড়নের ব্যাপারে বলা হয়, ২০২০ সালে উইঘুর ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে চীনের ক্ষমতাসীন সরকার। মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো হলো যথেচ্ছভাবে উইঘুরদের আটক ও বন্দিশিবিরে পাঠানো, জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, শ্রমদানে বাধ্য করা এবং ধর্মপালন, মতপ্রকাশ ও চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জিনজিয়াং প্রদেশে চীন প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের আটকে রেখেছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা। এছাড়া চীনের মূলধারার হ্যান জনগোষ্ঠীকে জিনজিয়াংয়ের কিছু এলাকায় বসবাসের জন্য স্থানান্তর করা হয়েছে। অন্যদিকে উইঘুর শিশুদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ রয়েছে। ৫ জানুয়ারি ২০২২ উইঘুরদের ওপরে গণহত্যা চালিয়েছে চীন, স্বাধীন ট্রাইব্যুনালের রায় : উইঘুর ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন ও নিপীড়ন চালানোর মানসিকতা থেকেই চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর জন্মনিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য বাধ্যতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ চাপিয়ে দিচ্ছে। চীনা কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপকে কার্যত গণহত্যা হিসেবেই উল্লেখ করেছে ট্রাইব্যুনাল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক এই ট্রাইব্যুনাল বলছে, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের টার্গেট করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা না ঘটলেও মূলত উইঘুর মুসলিমরা যেন তাদের জনসংখ্যা বাড়াতে না পারে সে লক্ষ্যেই কাজ করছে বেইজিং। উইঘুর ট্রাইব্যুনালের প্রধান এবং মানবাধিকার বিষয়ক প্রখ্যাত আইনজীবী স্যারজিওফ্রে নাইস বলেছেন, উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা কমাতে চীনা সরকার তাদের ওপর জন্মনিয়ন্ত্রণসহ বাধ্যতামূলক নানা পদক্ষেপ চাপিয়ে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ট্রাইব্যুনালের সবাই প্রশ্নাতীতভাবেই এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে, নানা অমানবিক পদক্ষেপের মাধ্যমে চীনা সরকার উইঘুর মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। তার ভাষায়, ‘চীনা সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা বা অনুমোদন না পেলে উইঘুর মুসলিমদের ওপর এ ধরনের ব্যাপক দমনপীড়ন চালানো সম্ভব নয়।’

১০ ডিসেম্বর ২০২১ উইঘুরদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করে বিলিয়ন ডলার কামাচ্ছে চীন : চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয় এ সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের প্রতি দেশটির সরকারের দমন-পীড়ন ও জাতিগত নিধন অভিযান নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে উদ্বেগ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ১৫ লাখ উইঘুর মুসলিমকে বন্দি শিবিরে আটকে রেখে বর্বর নির্যাতন, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে বিক্রি এবং নারী-পুরুষদের সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা নষ্ট করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী ও মানবাধিকার সংস্থা চীনের নিন্দা জানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসিইনস্টিটিউট (এএসপিআই) বলছে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার উইঘুরকে জিনজিয়াং থেকে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের কারখানায় পাচার করা হয়েছে। এই উইঘুরদের জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে কোটি কোটি ডলার অর্থ সংগ্রহ করছে চীন। দেশটির কালোবাজারে বছরে কমপক্ষে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে চীনের একটি আদালতে দেশটিতে প্রায় ৬০ হাজার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে বলে জানানো হয়। তবে এই সংখ্যা দাতাদের তুলনায় অনেক বেশি। চীনের যেসব হাসপাতালে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়, সেসবের বেশির ভাগেরই অবস্থান উইঘুর বন্দিশিবিরের আশপাশের এলাকায়। এএসপিআই বলছে, কালোবাজারে একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যাপক চড়াদামে বিক্রি হয়। দেশটিতে একটি ভালো লিভার প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ডলারে বিক্রি হয়। যা চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যদের কাছ থেকে বছরে যে অর্থ সংগ্রহ করে তার চেয়েও অনেক বেশি। তাইওয়ান নিউজের এক অনুসন্ধানে গত কয়েক বছরে চীনের কর্মকর্তারা উইঘুরদের মালিকানাধীন প্রচুর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। এসব সম্পত্তি প্রায় ৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করা হয়। সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের একজন ভুক্তভোগী হলেন আবদু জেলিল হেলিল। উইঘুর এই ধনকুবের রফতানিকারককে ২০১৭ সালে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগে আটক করে চীনা পুলিশ। পরে তাকে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পত্তি চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাইওয়ান নিউজ দাবি করেছে, তার ওই সম্পত্তি চীনা সরকারি কর্মকর্তারা বিক্রি করেন। সূত্র: হেরাল্ডসান অস্ট্রেলিয়া, নিউজ অস্ট্রেলিয়া। মুসলিমদের মুছে ফেলতে চাইছে চীন: অ্যামনেস্টি : চীনের উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে ১৬০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

‘আমরা যেন যুদ্ধে শত্রুপক্ষ’শিরোনামে রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত গবেষণা করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এই সময়ের মধ্যে তারা ১২৮ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ জন চীনের উইঘুর শিবিরে ছিলেন। আর ৬৮ জন সেইসব পরিবারের সদস্য, যেসব পরিবারের কেউ না কেউ হারিয়ে গেছেন বা তাদেরকে আটক করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। রিপোর্ট বলছে, জিনজিয়াংয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষকে বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়েছে। মুসলিমদের ভয় দেখানোর জন্য চীন তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাইটগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। প্রচুর সাক্ষী অ্যামনেস্টিকে বলেছেন, চীন মুসলিমদের মুছে ফেলতে চায়। অনেকে বলেছেন, তাদের মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এমনকি মসজিদে এবং মুসলিমদের বাড়িতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ছবি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই বলেছেন, তারা চীনে নিজেদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে ভয় পাচ্ছেন। তারা জানেন যে, রাষ্ট্র তাদের ওপর নজর রাখছে। উইঘুর শিবিরের কথা : রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোনোরকম সতর্কতা ছাড়াই মাঝরাতে বাড়ি থেকে তুলে উইঘুরদের শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের তথাকথিত শিক্ষা-শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জোর করে নিজেদের অপরাধের কথা স্বীকার করানো হয়। তারপর তাদের মধ্যে কিছু মানুষকে শিবিরে রাখা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়- তারা সন্ত্রাসবাদী এবং বিশ্বাসযোগ্য নয়। যাদের শিবিরে আটকে রাখা হয়েছিল, তাদের কয়েকজন অ্যামনেস্টিকে বলেছেন, শিবিরের অবস্থা চীনের কারাগারের থেকেও খারাপ। তাদের সংশোধন-ক্লাসে যেতে হয়। তার আগে সারাদিন তাদের বসিয়ে রাখা হয়। শিবিরের ক্লাসে তাদের ইসলামের‘খারাপ’দিকগুলো বাধ্যতামূলক ভাবে শিখতে হয়। অ্যামনেস্টির সুপারিশ : এই মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, অপরাধের অকাট্য প্রমাণ না থাকলে শিবির থেকে সব উইঘুর মুসলিমকে মুক্তি দিতে হবে চীনকে। একইসঙ্গে এই শিবির বন্ধ করতে হবে। উইঘুরদের বিরুদ্ধে যাবতীয় অত্যাচার ও তাদের হেনস্থা করা বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ও অপরাধের তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক দল পাঠাতে হবে। অ্যামনেস্টির সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, ‘চীনমানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে, তা তথ্য-সহ এই রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। অন্য দেশগুলোকে সাহসী ভূমিকা নিতে হবে এবং চীনকে এই কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করতে হবে।’ অ্যাগনেস আরও বলেছেন, ‘আমাদের দেয়া তথ্যপ্রমাণগুলো জানার পরও দেশগুলোর পক্ষে চুপ করে বসে থাকা মুশকিল।’যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে উইঘুরদের প্রতি চীনের নীতিকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে।

শহিদুল ইসলাম কবির: সম্পাদক, মাসিক মদীনার পয়গাম ও সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কাউন্সিল

সর্বশেষ - মতামত