ইসি নিয়োগের আগের নকশাই থাকছে আইনে

মন্ত্রিসভা অনুমোদিত নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের প্রস্তাবিত আইন এবং পাঁচ বছর আগে রাষ্ট্রপতি গঠিত অনুসন্ধান কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি প্রায় অভিন্ন। বাদ পড়েছে শুধু একজন নারী কমিশনারের জন্য নাম প্রস্তাবের বিষয়টি।

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল বুধবার বলেন, ‘আইন প্রণয়ন এবং সেই আইন অনুসারেই এবার নির্বাচন কমিশন গঠনের সম্ভাবনা বেশি। আগামী রবিবার আমি জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত আইনের বিল উত্থাপন করব। করোনা সংক্রমণ আরো ভয়াবহ না হলে আশা করছি, আগামী সপ্তাহেই এই আইন জাতীয় সংসদে পাস হবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের দাবি করেছিল। আমরাও নাগরিক সমাজের পক্ষে থেকে একই দাবি করেছিলাম। সরকার সেই দাবি পূরণে কৌশলের আশ্রয় নেবে বলে মনে হয়। সব অংশীজনের মতামত না নিয়ে এই দায়সারা আইনে কোনো সুফল মিলবে না।’

প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের ‘যে লাউ সেই কদু’ মন্তব্য ও নাগরিক সমাজের একাংশের সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিএনপি নেতারাসহ একটি চিহ্নিত মহল নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের মহৎ উদ্যোগকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তাদের চিরাচরিত অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের অপরাজনীতিতে লিপ্ত হয়েছে।’

আগের পদ্ধতিই বহাল থাকছে : ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য যে অনুসন্ধান কমিটি করে দেন, তার সদস্যসংখ্যা ছিল ৬। গত সোমবার মন্ত্রিসভা কমিটিতে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ শিরোনামে যে প্রস্তাবিত আইন অনুমোদন পেয়েছে তাতেও অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ছয়জন রাখা হয়েছে। এই ছয়জনের মধ্যে চারজনের পদ-পদবি আগের মতোই থাকছে। থাকছেন আপিল বিভাগের একজন বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান। গতবার রাষ্ট্রপতি এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন করে শিক্ষককে অনুসন্ধান কমিটিতে রেখেছিলেন। প্রস্তাবিত আইনেও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি দুজন প্রতিনিধি দেবেন।

পাঁচ বছর আগে এবিষয়ক গেজেটে অনুসন্ধান কমিটির কাজের সময়সীমা ছিল কমিটি গঠনের পর ১০ কার্যদিবস। প্রস্তাবিত আইনেও একই সময় রাখা হয়েছে। গতবার উল্লেখ ছিল, অনুসন্ধান কমিটি প্রতিটি পদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। প্রস্তাবিত আইনেও তা-ই বলা হয়েছে। তিন সদস্যের উপস্থিতিতে কমিটির কোরাম হবে বলে গতবার বলা হয়েছিল। প্রস্তাবিত আইনেও একই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আগেরবার প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারককে অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। প্রস্তাবিত আইনে তা অভিন্ন রেখে ‘আহ্বায়ক’ শব্দটি পরিবর্তন করে ‘সভাপতি’ করা হয়েছে। আগের অনুসন্ধান কমিটিকে সাচিবিক সহায়তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে। প্রস্তাবিত আইনে এটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

গতবারের অনুসন্ধান কমিটি সম্পর্কিত সরকারি গেজেটে উল্লেখ না থাকলেও অনুসন্ধান কমিটি রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নির্বাচন কমিশনার ও অন্য চার নির্বাচন কমিশনারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নামের প্রস্তাব চেয়েছিল। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, কমিটি রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে।

একটি ক্ষেত্রে পার্থক্যও আছে। গতবার অনুসন্ধান কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বলা ছিল, অনুসন্ধান কমিটি ন্যূনতম একজন নারীসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ করবে। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে নারীর কথা বলা হয়নি।

প্রস্তাবিত আইনে এসবের বাইরে যে বিষয়গুলো যোগ করা হয়েছে, সেগুলো হলো নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নির্ধারণ এবং আগের নির্বাচন কমিশনারদের দায়মুক্তি। প্রস্তাবিত আইনের ৯ ধারায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ইতোপূর্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি ও তৎকর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলি এবং উক্ত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ বৈধ ছিল বলিয়া গণ্য হবে এবং উক্ত বিষয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ খসড়া আইনের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণে প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে বিধি প্রণয়ন করা যাবে।

ইসি গঠনে আইন ছাড়াই ২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো গঠন করা হয় অনুসন্ধান কমিটি। ওই কমিটির কার্যপদ্ধতিও ছিল গতবার এবং এবারের প্রস্তাবিত আইনের সঙ্গে প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ। তখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে  হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রককে নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে গতবারের মতো ওই কমিটিতেও নির্ধারিত পদ-পদবির বাইরে কাউকে রাখা হয়নি। ওই কমিটিকেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার নির্বাচন কমিশনারের জন্য দুটি করে নাম প্রস্তাব করতে ১০ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছিল।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ