ইভিএম প্রকল্পের ইতি টানছে সরকার

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সংক্রান্ত চলমান প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী জুন মাসে। সরকার প্রকল্পটির মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ‘নির্বাচন ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্পটির ইতি টানা হচ্ছে। তবে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাতে থাকা ইভিএমগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিদ্যমান ইভিএমগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছে।

নির্বাচন ব্যবস্থায় ইভিএম ব্যবহার শীর্ষক প্রকল্পটি নিয়ে সম্প্রতি নির্বাচন ভবনে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আগামী জুন মাসে মেয়াদ শেষে প্রকল্পটির সমাপ্তি টানার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে। এরপর বৈঠকে প্রকল্প সমাপ্তির জন্য ‘এক্সিট প্ল্যান’ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

বৈঠক সূত্র জানায়, ইভিএম প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা, কতগুলো এভিএম ব্যবহারযোগ্য, কতগুলো নষ্ট, কতগুলো মেরামতযোগ্য এবং প্রকল্পের বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকের কার্যপত্র সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, আপাতত ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ মনে হয় বাড়ছে না। মেয়াদ বাড়ার সম্ভাবনা দেখছি না।

বৈঠকে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অধিশাখার পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত ১২ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) সভায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সমাপ্তির জন্য ৩৩২টি প্রকল্প নির্ধারিত। সেই তালিকায় ইভিএম প্রকল্পটি রয়েছে। যথাসময়ে শেষ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেছেন বিধায় প্রকল্পটির মেয়াদবৃদ্ধির সুযোগ নেই। বিষয়টি পরবর্তী স্টিয়ারিং কমিটির সভায় আলোচনা হতে পারে বলে মত ব্যক্ত করেন।

বৈঠকে প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, ডিপিপি অনুসারে ইভিএমের আয়ুষ্কাল ১০ বছর। এ বিবেচনায় যাচাই-বাছাই পূর্বক মেরামতযোগ্য ইভিএমগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে ৩-৫ বছর মেয়াদে বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার করা যেতে পারে। অথবা ইভিএম ভবিষ্যৎ নির্বাচনে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত না হলে ইভিএমসমূহ ধ্বংস করা যেতে পারে। মেরামত ও বিনষ্ট উভয় ক্ষেত্রে অর্থ প্রয়োজন। এমতাবস্থায় ইভিএম মেরামতের সিদ্ধান্ত নিলে প্রকল্পের মেয়াদ ৬-১২ মাস বৃদ্ধির সুপারিশ করা যেতে পারে।

বৈঠকে আইএমইডির উপপরিচালক বলেন, ইভিএমসমূহ সংরক্ষণ ও স্থায়ী ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভেন্ডর নির্ভরশীলতার বিকল্প উদ্ভাবন এবং প্রকল্প সমাপ্তির পর ডিপিপিতে বর্ণিত ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার অনুযায়ী মালামাল বুঝে নেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটি যেহেতু জুনের মধ্যে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত রয়েছে, সেহেতু এখন থেকেই পিসিআর প্রণয়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের উপপ্রধান প্রদীপ সিংহ বলেন, আগামী ৩০ জুনে ইভিএম প্রকল্প শেষ হচ্ছে। এর জন্য এক্সিট প্ল্যান সফলভাবে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। তিনি কারিগরি কমিটি গঠনের পক্ষে মতামত দেন।

প্রকল্প পরিচালক জানান, ইভিএম প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের অনুমোদিত প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের ডিপিপির ক্রয় প্যাকেজের আওতায় ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ টাকা দরে মোট দেড় লাখ ইভিএম সেট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে বিএমটিএফ হতে ক্রয় করা হয়। ইভিএম ব্যবহার করে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ সর্বমোট ১৩৯৫টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বারবার ব্যবহারের কারণে অধিকাংশ ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করা আবশ্যক। বর্তমানে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) গুদামে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫টি এবং মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন কার্যালয়ে ৪৮ হাজার ২৬৭টি এবং নির্বাচন ভবনের বেজমেন্টে ৬৯৮টি ইভিএম সংরক্ষিত আছে। বিএমটিএফ ইভিএম সংরক্ষণের জন্য গুদামের ভাড়া বাবদ সর্বমোট ৫৩ কোটি ৭৫ লাখ দাবি করছে। প্রকল্প পরিচালক ভাড়ার বিষয়টি মীমাংসা করা এবং ভবিষ্যতে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইভিএমসমূহ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের প্রয়োজন বলে মত ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, ইভিএম প্রকল্পের এক্সিট প্ল্যানের বাস্তবায়ন চলমান আছে।

দীর্ঘ আলোচনা শেষে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে রয়েছে- প্রকল্পের আওতায় ক্রয়কৃত ইভিএম মেশিন দ্বারা কী কী কাজ করা যাবে তা পরীক্ষার জন্য স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে কারিগরি কমিটি গঠন করতে হবে। ইভিএম ডেটা কাস্টমাইজেশন ও সফটওয়্যার সংক্রান্ত প্রশিক্ষণে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের রাজস্ব খাতের জনবলকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত জনবল হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে কিনা সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

২০১০ সালে এটিএম শামসুল হুদা কমিশন ইভিএম চালুর পর সিটি করপোরেশনে বড় পরিসরে ব্যবহার করেছিল। ২০১২ সালে কাজী রকিব কমিশন আগের ইভিএমকে অনেকটা অকেজো অবস্থায় ফেলে গিয়েছিল। এরপর কেএম নূরুল হুদা কমিশন নতুন করে ইভিএম নিয়ে এগোয়। ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প অনুমোদন পায়। পরে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনে স্থানীয় সরকারের সিংহভাগ নির্বাচনই হয়েছে ইভিএমে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা ছিল ইসির। কিন্তু রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা ও কোভিড-পরবর্তী সময়ে আর্থিক সংকটের মধ্যে আরও দুই লাখ ইভিএম কেনার প্রস্তাবে সরকার সায় দেয়নি।

ইভিএম প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ইসির হাতে থাকা মেশিনগুলো কী হবে, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কমিশনে কোনো আলোচনা হয়নি।