ইন্টারনেট ব্যবহারের নাগরিক দায়বোধ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বিশ্ব আজ ‘পোস্ট-ট্রুথ’ যুগ অতিক্রম করছে। প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করে আবেগ এবং বিশ্বাসের বশীভূত হওয়াকে ‘পোস্ট-ট্রুথ’ হিসেবে বলা হয়।

‘পোস্ট-ট্রুথ বা ‘সত্য-উত্তর যুগ’ হচ্ছে এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে মানুষ আসল ঘটনা বা সত্যের বদলে তাদের আবেগ ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কোনো একটি যুক্তিকে গ্রহণ করে নেয়।

তার অর্থ হচ্ছে, এখানে সত্যকে ছাপিয়ে ভাবাদর্শ বা আইডিওলজি বড় হয়ে ওঠে। এটি এক ধরনের আদর্শের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, যা দিয়ে এর প্রচারকরা অন্যদের এমনটি বিশ্বাস করাতে চান, যার বিপরীতে যথেষ্ট সাক্ষ্য রয়েছে।

এ পোস্ট-ট্রুথ যুগে ‘অল্টারনেটিভ ফ্যাক্টস’ বা বিকল্প সত্য এবং ‘ফেক নিউজ’ এর সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের স্থিতিশীলতার লড়াই চলছে প্রতিনিয়ত। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন জীবনের অনুষঙ্গ।

একদিকে ইন্টারনেট আমাদের মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করছে, আমাদের সময় বাঁচাচ্ছে এবং সভ্যতার অগ্রগতিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে; কিন্তু অন্যদিকে এটি আমাদের ভুল তথ্য দিয়ে প্রচুর সময় কেড়ে নিচ্ছে এবং নৈতিকভাবে কলুষিত করছে।

আমাদেরই বিবেচনা করে দেখতে হবে কীভাবে আমরা সারা বিশ্বের তথ্য আহরণের এ মাধ্যমকে নিজেদের উপকারের জন্য ব্যবহার করতে পারি।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যাও। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এ অবারিত সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তার দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। তার ঘোষণা অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

তবে একুশের জন্য অপেক্ষা না করে ২০১৯ সালেই সেই সময়সীমার কাছাকাছি আমরা পৌঁছে গেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের শেকড় রোপণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দেশটিকে আইটিইউর সদস্যপদ গ্রহণ করান ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধন করেন।

সমস্যা হল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উপযুক্ত ব্যবহারের পাশাপাশি অপব্যবহারও হচ্ছে এবং হালে তা ব্যাপকহারে বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ফেক নিউজ বা গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বড় ভূমিকা পালন করছে।

এ মাধ্যমের সুবিধা হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো তথ্য ছড়াতে বেগ পেতে হয় না। যা মন চায়, লিখে পোস্ট করা যায়। পুরো বিশ্ব আজ এ সমস্যা মোকাবেলা করছে। আমেরিকা বা ইউরোপ, এমনকি আফ্রিকাও এমন সময় পার করছে। ভারতও এর বাইরে নয়। আমরাও সেই সময় পার করছি?

ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বস্ত সোর্স, সাংবাদিক এবং প্রচার মাধ্যম থেকে আমরা সংবাদ পেতাম। যারা কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। কিন্তু ইন্টারনেট আসার পর তথ্য প্রচারের প্রবিধান খুব সামান্যই অনুসরণ করা হচ্ছে।

এরই সঙ্গে তথ্য ও সংবাদগ্রহণ, প্রকাশ, বিনিময়েও আমাদের ইন্টারনেট যথেচ্ছ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। এ সুযোগে ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। অথচ এসব ব্যবহারে দেশে এখনও কোনো গাইডলাইন তৈরি হয়নি।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময় এসেছে অন্তত একটা নীতিমালা তৈরির। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা হচ্ছে, তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

নীতিমালা তৈরি হলে সবার উদ্বেগ কমবে এবং ওই মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারীরা নিরাপদ থাকবে। কিন্তু নীতিমালা দিয়ে ইন্টারনেট অপব্যবহার বন্ধ সম্ভব নয়।

এজন্য ডিজিটাল লিটারেসি ও নৈতিকতা বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে অনেকেই তথ্য আপলোড বা শেয়ার করে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করছেন। গুজব ছড়ানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।

ইন্টারনেটের হাতিয়ারকে সারা বিশ্বের ভাব বা তথ্য বিনিময়ের এক হাতিয়ার বলা হচ্ছে। আমরা যখন এ ‘ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে’ বা ‘তথ্যের মহাসড়কের’ মধ্য দিয়ে যেতে থাকি, তখন বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তথ্য, পরিসংখ্যান এবং মতামত বেছে নিতে পারি।

ব্যবহারকারীদের অনেকেরই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে ফিল্টারিং (যাচাই-বাছাই) করার ক্ষমতা কম। তাদের অনেকের ধারণা ফেসবুকে যে সূত্রে একটি সংবাদ এসেছে, তাতে মিথ্যা তথ্য থাকার কথা নয়।

ফলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে নিজের বিপদ থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যা বা ফেক নিউজ যে মতলবে প্রচার করা হয়, তা খুব সহজেই কাজ করে।

সরকার এরই মধ্যে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কার্যকম হাতে নিয়েছে। পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। আইসিটি বিভাগের অধীনে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি গড়ে তোলা হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমের (ডিওটি) অধীনেও সিকিউরিটি এজেন্সি হয়েছে।

বিটিআরসিতে (টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা) সংশ্লিষ্ট শাখা রয়েছে। সরকার যখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে তখন স্বাধীনতা এবং উন্নয়নবিরোধী শক্তি ইন্টারনেটের আশ্রয় নিয়ে ফেক নিউজ বা গুজব ছড়িয়ে দেশের অগ্রগতিতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

কখনও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার পাঁয়তারা করছে, কখনও সেতুনির্মাণে শিশুর কাটা মাথা লাগবে বলে গুজব রটানো হয়েছে।

প্রতিবারই সরকার কঠোর হাতে এ অপচেষ্টাকে দমন করেছে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি জনগণের মাঝে এ সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

গুজব প্রতিহত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো দ্রুততার সঙ্গে প্রকৃত তথ্য জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছে বলেই জনমনের বিভ্রান্তি দূর হচ্ছে। কেবল এ বছরই তথ্য অধিদফতর ২০টি তথ্যবিবরণী ও ১টি প্রেসনোট প্রকাশ করেছে, যেখানে গুজবের তথ্যের বিপরীতে সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।

গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ কমিটি গঠন করা হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে। অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের এ কমিটি গুজব শনাক্ত ও প্রতিরোধে কাজ করছে। তথ্য অধিদফতর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে।

এ অধিদফতরেও ১১ সদস্যবিশিষ্ট গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল গঠিত হয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে গুজব চিহ্নিতকরণ ও প্রকৃত তথ্য প্রচার কাজে এ সেল কাজ করছে।

ইতিমধ্যে ৭০টি ফেসবুক আইডি, ২৫টি ইউটিউব চ্যানেল, ১০টি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের নেতৃত্বে স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয়েছে গুজব প্রতিরোধ কমিটি।

এগুলো সরকারের গৃহীত প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপ। কিন্তু গুজব মোকাবেলায় সবার আগে দরকার জনসচেতনতা বাড়ানো। কোনটি সঠিক তথ্য, কোনটি ভুল তথ্য এবং কোন তথ্য ছড়িয়ে দিলে দেশ ও দশের ক্ষতি হতে পারে, মানুষের প্রাণ চলে যেতে পারে, সেই সচেতনতা গড়ে তোলা একান্তই জরুরি।

এজন্য জনসচেতনতা গড়ে তুলতে ‘সত্য-মিথ্যা যাচাই আগে, ইন্টারনেটে শেয়ার পরে’ এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দেশে পালিত হল ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০১৯।

মানুষের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়ানো খুবই জরুরি। এ সাক্ষরতা আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্মার্ট করে তুলবে। ইন্টারনেটে যেসব তথ্য পাওয়া যায় সেগুলোর সবই ভালো ও উপকারী, তা কখনও নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করা যাবে না।

তথ্যটি নির্ভরযোগ্য নাকি অনির্ভরযোগ্য, সবার আগে তা যাচাই করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এমন যে কোনো ব্যক্তি নিজের নাম প্রকাশ না করেও কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে দাবি করতে পারেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য পেলেই কি তা শেয়ার করতে হবে? যদিও আমাদের তথ্য সংগ্রহ করার এবং তা অন্যদের কাছে জানানোর স্বাধীনতা রয়েছে, একইসঙ্গে আমাদের সেই তথ্যের সত্যতা ও যথার্থতা নিশ্চিত করার দায়িত্বও রয়েছে।

অন্যদের কাছে আমরা যা লিখি এবং পাঠাই, সেটার যথার্থতা সম্বন্ধে প্রমাণ দিতে পারলেই তখন তা অন্যদের কাছে পাঠাতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনতে হবে যে, তথ্যটি সমাজের জন্য হিতকর ও গঠনমূলক।

শুধু ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে অন্যদের প্রভাবিত করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া তথ্য শেয়ার করা মোটেও স্মার্টনেস নয়। তাই সেন্ড বাটনে চাপ দেয়ার আগে আমাদের উপরোক্ত ভাবনাগুলোকে মাথায় রাখতে হবে।

পরীক্ষিৎ চৌধূরী : সরকারি চাকরিজীবী