আড়িয়া গ্যারিসনের পতন ঘটানো শহীদ মাসুদের স্মৃতিসৌধের কী হবে?

বিলীন হতে চলেছে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়া বাজারে অবস্থিত শহীদ মাসুদ স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতার ৫১ বছরেও সরকারি স্বীকৃতি না পাওয়া, গুরুত্বহীনতা, অযত্ন, অবহেলা আর মহাসড়ক উন্নয়ন কাজের কারণে মুছে যেতে বসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্মৃতিসৌধটি। অপেক্ষা শুধু সড়ক উন্নয়ন কাজের বুলডোজারের হানার।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তীব্র লড়াই করে আড়িয়া গ্যারিসনের পতন ঘটাতে জীবন উৎসর্গকারী শহীদ মাসুদের এই স্মৃতিসৌধটি বিলীন হতে দেখে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়েছে অনেকেরই।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাক-ভারত বিভক্তির পর ১৯৬৬ সালে শাজাহানপুরের আড়িয়া বাজার এলাকায় সেনাবাহিনীর একটি গ্যারিসন (অস্ত্রাগার) স্থাপন করে পাকিস্তান সরকার। সেটিকে এসএমজি, এসএলআর, রাইফেল, কামানসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ করা হয়। মজুদ করা হয় প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ। অস্ত্রাগারটির নিরাপত্তা রক্ষায় ওই গ্যারিসনে কর্মরত ছিলেন কর্মকর্তাসহ ৭০ জন সেনাসদস্য। তাঁদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন বাঙালি। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণের পর যখন সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল তখন থেকেই শাজাহানপুরের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিকামী মানুষ, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আড়িয়া গ্যারিসনের পতনের পরিকল্পনা করছিলেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা প্রথমে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করেন। তারপর গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড দেওয়া ও খাদ্য অবরোধসহ নানা কর্মসূচি হাতে নেন।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল সকালে বগুড়া পুলিশ লাইনসে কর্মরত হাবিলদার আব্দুল লতিফ পাকিস্তান সরকারের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁর নেতৃত্বে বগুড়ার তৎকালীন প্রতিথযশা চিকিৎসক ডা. টি আহম্মেদের পুত্র মাসুদসহ ৫০-৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি সশস্ত্র দল আড়িয়া বাজার এলাকায় পৌঁছে। দলটির উপস্থিতিতে স্থানীয় মুক্তিকামী সাধারণ মানুষও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। গ্যারিসনে কর্মরত বাঙালি সেনাসদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে অস্ত্রসহ গ্যারিসন থেকে বেরিয়ে আসেন এবং যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। শুরু হয় প্রচণ্ড লড়াই। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধের পর গ্যারিসনের পতন যখন প্রায় নিশ্চিত ঠিক তখন বিজয় উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তারকাঁটাঘেরা প্রাচীর বেয়ে ওপরে ওঠেন ডা. টি আহম্মেদের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ। তিনি যখন প্রাচীর থেকে লাফিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করছিলেন তখন ওই গ্যারিসনের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নূরের (মতান্তরে ক্যাপ্টেন নূরের স্ত্রীর) গুলিতে লুটিয়ে পড়েন মাসুদ। তাঁর রক্তে রঞ্জিত হয় আড়িয়া বাজার এলাকা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন নূরসহ ১৮ জন সেনাসদস্য। পতন হয় আড়িয়া গ্যারিসনের।

বাংলার দামাল ছেলে শহীদ মাসুদের স্মৃতি রক্ষার্থে সে সময় স্থানীয়রা আড়িয়া বাজারের নতুন নামকরণ করেন শহীদ মাসুদ নগর। স্থানীয়দের উদ্যোগে নির্মিত হয় শহীদ মাসুদ স্মৃতিসৌধ। তখন থেকেই প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আসছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি স্থানীয়রা।

কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছরেও মাসুদ নগরের সরকারি কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক এই স্থানটির গুরুত্ব তুলে ধরতে সেখানে আজো নির্মিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কোনো স্থাপনা। বর্তমানে ঢাকা-বগুড়া জাতীয় মহাসড়ক উন্নয়ন কাজের কারণে অপসারণ করতে হচ্ছে স্মৃতিসৌধটি। যেকোনো সময় স্মৃতিসৌধটি উচ্ছেদ করা হবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নটি কি সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হবে নাকি চিরতরে বিলীন হবে- এমন প্রশ্ন অনেকের।

আড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম মন্টু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরেও স্বাধীনতার ৫১ বছরেও কেন সেখানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কোনো স্থাপনা নির্মিত হয়নি? কেন সরকারের স্বীকৃতি মিলছে না। লোকমুখে শোনা গেছে সেখানে স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কমপ্লেক্সের নির্মাণের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারও কোনো খবর নেই। এদিকে মহাসড়ক উন্নয়ন কাজের কারণে স্মৃতিসৌধটি যেকোনো সময় উচ্ছেদ করা হবে। বিলীন হবে স্মৃতিচিহ্ন। এ বিষয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ‘ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবি জানান তিনি।

শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ জানান, মহাসড়ক উন্নয়ন কাজের জন্য স্মৃতিসৌধটি সেখানে থাকছে না। আশপাশে কোথাও জায়গা পেলে সেখানে স্মৃতিচিহ্নটি সংরক্ষণ করা হবে।

তবে জনপ্রশাসন থেকে বরাদ্দের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ