আল্লামা শফী : নিভে গেল অসাম্প্রদায়িকতার এক বাতিঘর

দেশের শীর্ষ আলেম হেফাজতে ইসলামীর আমির আল্লামা আহমদ শফী আর নেই। ১০৪ বছর বয়সে জীবনের পারাপারে চলে গেছেন এই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যুর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক উজ্জ্বল বাতিঘর নিভে গেল। ধর্মীয় তত্ত্ব অনুযায়ী ইসলামে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। মহানবী (সা.) তার অনুসারীদের এ চেতনাতেই উদ্বুদ্ধ করেছেন। আল্লামা শফী হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ইসলামের সহনশীল ও উদার চেতনায় সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছেন।

দেশের শতবর্ষী প্রবীণ এ আলেমের মৃত্যুতে বিভিন্ন মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক জানিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও আল্লামা শফীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদকে হারাল।’ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তিনি দেশের ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। পাশাপাশি কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নেও ভূমিকা রেখেছেন।’

আল্লামা শাহ আহমদ শফীর জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পাখিয়ারটিলা গ্রামে। হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষে তিনি ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষা নেন। তিনি ১৯৮৬ সালে দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে যোগ দেন। টানা ৩৪ বছর ধরে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। হাটহাজারীতে তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা। এ মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেশির ভাগই তাঁর ছাত্র। যে কারণে তাঁর সঙ্গে কেউই দ্বিমত পোষণ করতেন না।

দেশের শীর্ষ কওমী আলেম ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফীর নামাজে জানাজা হাটহাজারীতেই সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার দুপুর ২টার দিকে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ও এতে ইমামতি করেন তার বড় ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসূফ।
এর আগে দেশের শীর্ষ আলেমকে শেষ বিদায় জানাতে চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা অভিমুখে লাখো মানুষের ঢল নামে। শনিবার ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসেন লাখো ভক্ত-অনুসারী। জনতার ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় প্রশাসনকে।

দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম এ জানাজা উপলক্ষে এলাকাজুড়ে বাড়ানো হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়। হাটহাজারী, পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি এই ৪ উপজেলায় দায়িত্ব পালন করেন ৭জন ম্যাজিস্ট্রেট।

বাংলাদেশকে বলা হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশেই সব ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক বিরাজ করছে শত শত বছর ধরে। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষ এ দেশে পাশাপাশি বাস করছে সুপ্রতিবেশীর মতো। দেশের ইসলামী শিক্ষার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র চট্টগ্রামের দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা। হেফাজতে ইসলামেরও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই মাদ্রাসাটি। শত বছরের বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান এই কওমি মাদ্রাসার সীমানা দেয়ালের পাশেই সহাবস্থান করছে সনাতনধর্মের শ্রী শ্রী সীতাকালী মন্দির, যা মাদ্রাসার প্রধান মসজিদের মাত্র কয়েক গজ দূরে অবস্থিত। কিন্তু মন্দিরের পূজারিরা মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকের কাছ থেকে কখনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হননি। ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে শ্রীশ্রী সীতাকালী মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদককে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সব সময় মন্দিরের ব্যাপারে আন্তরিক। তারা কখনো মন্দিরের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করেন না। অন্যদিকে মন্দিরের পূজারিরাও চেষ্টা করেন, যাতে তাদের কর্মকণ্ডের মাধ্যমে মাদ্রাসা বা মসজিদের কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। শত বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম যার যার অবস্থানে থেকে হাটহাজারীতে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। বাবরি মসজিদ ভাঙা, কিংবা গুজরাটের দাঙ্গার রেশ ধরে দেশের কোনো কোনো স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর হামলার ঘটনা ঘটলেও হাটহাজারীতে ছিল ব্যতিক্রমী চিত্র। ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় হামলা দূরে থাক, উল্টো মাদ্রাসাছাত্ররা পাহারা দিয়ে মন্দির রক্ষা করেছেন। ইসলাম যে সত্যিকারভাবে অন্য ধর্মের অনুসারীদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, সে নজির দেখিয়েছেন হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

 

হাটহাজারীতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই উদাহরণ সৃষ্টিতে হেফাজতে ইসলামীর আমির ও দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসারা মহাপরিচালক আল্লামা শফীর অবদান ছিল অনন্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই মহান চেতনা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন তার মরুব্বিদের কাছ থেকে। যারা তার আগে হাটহাজারী মাদ্রাসার নেতৃত্ব দিয়েছেন। আল্লামা শফীকে যারা সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিভূ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন মতলববাজি মনোভাবে, তারাও তাদের এলাকার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে এই মরহুম ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মত দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছেন কিনা আমাদের জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধে দেশের আলেম-ওলেমাদের অবদান সমাজের অন্য কোনো অংশের চেয়ে কম নয়। ঘাতক দালাল রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আলেম সমাজের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কওমী মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা ঐতিহ্যগতভাবে মওদুদীবাদ বা জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। হাটহাজারী মাদ্রাসার মসজিদের পাশে মন্দিরের অবস্থান এবং দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সেই চেতনাই ধারণ করছে। অসাম্প্রদায়িকতার এই চেতনা সবার জন্য অনুসরণীয় হওয়া উচিত। হাটহাজারীর অসাম্প্রদায়িকতার সুবাস দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ুক এমনটিই কাম্য। আল্লামা আহমদ শফীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
ই-মেইল :  sumonpalit@gmail.com

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন