আলোচনায় ব্যাংক আমানতে শুল্ক আরোপ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনের পর সব কিছু ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে ব্যাংকের স্থায়ী আমানতে আবগারি শুল্ক আরোপের ইস্যুটি। বিশেষ করে ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাবে প্রায় এক কোটি আমানতকারী আতঙ্কে রয়েছেন।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেসরকারি ব্যাংকে এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক (এক্সাইজ ডিউটি) যদি আটশ টাকা কেটে রাখা হয়, তাহলে আমানতকারী কোনও লাভই পাবেন না। আর সরকারি ব্যাংকে কেউ এক লাখ টাকা তিন মাস মেয়াদে এফডিআর করলে, মেয়াদ শেষে লাভের বদলে নিজের আসল টাকা থেকেই কম পাবেন গ্রাহক।

এ অবস্থায় ব্যাংক থেকে তুলে মাটির ব্যাংকে টাকা রাখার কথা ভাবছেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা রাখলে যদি লোকসান গুনতে হয়, তাহলে মাটির ব্যাংকে টাকা রাখবো।’

বেসরকারি একটি অফিসের কর্মকর্তা জায়েদা আখি বলেন, ‘আগামী রবিবারই ব্যাংক থেকে আমানতের টাকা উঠিয়ে অন্য কোথাও বিনিয়োগ করবো।’

এদিকে সম্পদশালীদের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তিনি বলেন, ‘যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকার বেশি থাকবে, শুধু তাদের ওপর এটা প্রযোজ্য করেছি।’ শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

প্রসঙ্গত, বছরের যেকোনও সময় ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকা ডেবিট কিংবা ক্রেডিট হলে এতদিন ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হতো। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী ৮০০ টাকা শুল্ক প্রস্তাব করেন। আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এক লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কেউ ব্যাংকে টাকা রাখলে, তাকে আবগারি শুল্ক দিতে হবে ৮০০ টাকা। ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত কেউ আমানত রাখলে তাকে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হবে দুই হাজার ৫০০ টাকা। এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা অ্যাকাউন্টে রাখলে, তার ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ করা হবে ১২ হাজার টাকা। এছাড়া পাঁচ কোটি টাকার বেশি ব্যাংকে টাকা রাখলে তাতে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হবে ২৫ হাজার টাকা।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এমনিতেই আমানতকারীরা সুদের হার কম পাচ্ছেন। এর সঙ্গে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখাও হচ্ছে। তার ওপর আবার শুল্ক আরোপ করা হলে আমানতকারীরা শঙ্কায় থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। শুধু ব্যাংকে টাকা রাখবে-কেবল সেই কারণেই সরকার টাকা কেটে নেবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন।’

তিনি বলেন, ‘এর ফলে এখন মানুষ ব্যাংক বিমুখ হবে। ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে টাকা রাখা শুরু করবে। অস্বচ্ছ খাতে টাকা রাখবে। অনেকে টাকা দেশের বাইরেও নিয়ে যাবে।’

এই করারোপকে খারাপ ট্যাক্স উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এভাবে করারোপ করা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। টাকা দরকার, কিন্তু যে কোনোভাবে নয়।’ অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব কার্যকর হলে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এক লাখ টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা ৮৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬ জন। এর মধ্যে ১ থেকে ২ লাখ টাকা রেখেছেন ৩৩ লাখ ৬২ হাজার ৯১৪ জন। ২ লাখ টাকা থেকে ৩ লাখ টাকা রেখেছেন ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৬৫ জন। ব্যাংকে ৩ লাখ টাকা থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত রেখেছেন ৭ লাখ ৯১ হাজার ৮৯২ জন।  ৪ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা রেখেছেন ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৬০৩ জন। ৫ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকার আমানত রেখেছেন ১২ লাখ ১৭ হাজার ৪৯৫ জন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদ ৫ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে। এদিকে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ।

ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, ‘আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘ব্যাংক সুদের হার এখন অনেক কম। এর ওপর এমনিতেই মূল্যস্ফীতি, উৎসে কর, মেইনট্যানেন্স চার্জ মিলিয়ে যা কেটে রাখা হয়, আমানতকারীর লাভ বলতে আর কিছুই থাকবে না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকগুলো এখন সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ সঞ্চয় স্কিমেও সুদের হার নেমে এসেছে একই পর্যায়ে। অনেক ব্যাংকের সুদের হার  ৫ শতাংশের কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্চ মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৫৭টি ব্যাংকে আমানত হিসাবের সংখ্যা প্রায় আট কোটি। এর মধ্যে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেকের বেশি মেয়াদি আমানত। সঞ্চয়ী আমানত রয়েছে ২০ শতাংশের মতো।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘যারা ব্যাংকে টাকা রাখেন, তারা একটি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে থাকেন। ব্যাংকে যে টাকা আমানত থাকে, তা আয়কর রিটার্নে প্রদর্শিত হয় ও ট্যাক্স দেওয়া হয়। কাজেই একই টাকার ওপরে আবার ‘আবগারি শুল্ক’ নামে ট্যাক্স কেটে নেওয়া উচিত নয়।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘এতে  ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। অন্যান্য সোর্স না বাড়িয়ে একই জায়গা থেকে বার বার ট্যাক্স নেওয়া কোনও ভালো লক্ষণ নয়।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন