আরডিএ অফিসে শর্ত ভঙ্গ করে ১০ কর্মচারির নিয়োগ, মামলা ঝুললেও সুযোগ সুবিধা নিয়ে অবসরে অনেকে!

নিজস্ব প্রতিবেদক :

দুইটি নিয়োগকে কেন্দ্র করে সরকারের সাথে কানামাছি খেলছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়ার পর অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারি ইতোমধ্যে কর্মজীবন শেষ করে অবসরে গেছেন। শুধু তাই নয়, আরডিএ কর্তৃপক্ষ বিধিবর্হিভুতভাবে ১০ জন কর্মচারিকে নিয়োগ দেয়ার পর মন্ত্রণালয়কে একের পর এক বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে।

বারবার উপেক্ষা করা হয়েছে সরকারী নির্দেশনা। মন্ত্রণালয়কে উপেক্ষা করে ১০ জন কর্মচারিকে আরডিএ নিয়োগ দেয়ার পর অনেকেই চাকরির মেয়াদ শেষ করে সকল সুযোগ সুবিধা নিয়ে অবসরে গেছেন। আবার কয়েকজন অবসরের পথে। কিন্তু নিয়োগের দুটি মামলা ঝুলছে ১৯ থেকে ২২ বছর।

জানা গেছে, আরডিএ অফিসে জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ১৬ জানুয়ারী ১১ জন কর্মচারি নিয়োগের নিমিত্তে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিধি মোতাবেক আবেদন করার জন্য আহ্বান করা হয়। উল্লেখ্য করা হয়, আবেদনকারীর প্রার্থীর বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর হতে হবে। আর মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে ৩২ বছর।

বয়সের এফিডেভিট প্রযোজ্য নয়, এমনটি বলা হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আরো উল্লেখ করা হয় ১ থেকে ৭ নম্বর পদের প্রার্থীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। আর ৮ থেকে ১০ নং পদের প্রার্থীদের কেবল মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।

এদিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ১১টি পদের বিপরিতে একেকটি পদের জন্য একাধিক আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু আরডিএতে যারা মাস্টার রোলে কর্মরত ছিলেন তাদেরকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাইরের কোনো আবেদনকারীর চাকরি হয় নি। নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্র সূত্রে জানা গেছে, ১০টি পদে বিজ্ঞপ্তি দিলেও নিয়োগ কমিটি মোট ১৬ জনকে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়। এরমধ্যে ১০ জনকে আরডিএ’র মাস্টার রোল থেকে নেয়া হয়। দেখা গেছে, আরডিএ’র যে ১০ জনকে চাকরি দেয়া হয়েছে তাদের বিজ্ঞপ্তি অনুসরে আবেদন করার বয়স ছিল না। এমনকি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বয়স শিথিল বা প্রমার্জিনার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। কিন্তু আরডিএ কর্তৃপক্ষ এই ১০ কর্মচারির বয়স শিথিল করে নিয়োগ দেয়। যা নিয়োগ বিধি ও আইনের পরিপন্থি।

দেখা গেছে, ওই নিয়োগে হিসাব রক্ষক পদে চাকরি পেয়েছেন রুস্তম আলী। জন্ম তারিখ হিসাবে তার বয়স প্রমার্জিত করা হয়েছে ১২ বছর ১১ মাস ১৬দিন। নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষিরিক/কমপিউটার অপরেটর পদে চাকরি পেয়েছেন মনিরুল ইসলাম। জন্ম তারিখ হিসাবে তার বয়স প্রমার্জিত করা হয়েছে ৯ বছর ৪ মাস ৩ দিন। নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক/কমপিউটার অপরেটর পদে চাকরি পেয়েছেন মোস্তাক আহমেদ। তার বয়স শিথিল করা হয়েছে ৩ বছর ১ মাস ৯দিন। হিসাব সহকারী পদে চাকরি পেয়েছেন আবু মোতাসিম। তার বয়স শিথিল করা হয়েছে ১৭ বছর ৬ মাস ২০দিন। বর্তমান তিনি চাকরির মেয়দ শেষ করে সকল সুযোগ সুবিধা নিয়ে অবসরে গেছেন। সার্ভেয়ার পদে চাকরি পেয়েছেন সাইদুর রহমান। সাইদুর রহমানের বয়স শিথিল করা হয়েছে ১০ বছর ৭ মাস ৯ দিন। তিনিও অবসরে গেছেন। গাড়ি চালক পদে রয়েছেন নুরুল ইসলাম। তার বয়স শিথিল করা হয়েছে ২ বছর ১১ মাস ১৩দিন। গাড়ি চালক পদে রয়েছেন আফতাব হোসেন। তার বয়স শিথিল করা হয়েছে ৭ বছর ১১ মাস ৭দিন। এমএলএসএস পদে রয়েছে আনোয়ার হোসেন। তার বয়স শিথিল করা হয়েছে ৪ বছর ৫ মাস ১৪ দিন। প্রহরী পদে আছেন মুনসুর রহমান। তার বয়স শিথিল করা হয়েছে ৪ বছর ৫ মাস ১৪ দিন। ঝাড়ুদার পদে চাকরি পেয়েছেন জাহানারা খাতুন। তার বয়স শিথিল করা হয়েছে ২ বছর ৭ মাস।

এই ১০ জন কর্মচারির নিয়োগে অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠলে ২০০৩-০৫ সালে নিরীক্ষায় অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়। মন্ত্রণালয়ের অডিটে ধরা পড়ে এই ১০ জন কর্মচারিকে অবৈধভাবে নিয়োগের বিষয়টি। পরে অডিট অধিদপ্তর নিয়োগ বোর্ডের সদস্যের প্রশাসানিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

বিধিবির্হিভুতভাবে ১০ জন কর্মচারিকে নিয়োগ দেয়ার পর আরডিএ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন গত ২০১১ সালের ১৭ জুলাই মামলা দায়ের করে। মামলায় উল্লেখ করা হয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তভঙ্গ করে সুযোগ, সুবিধা নিয়ে, প্রার্থীদের বয়স শিথিল করে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল বাদ দিয়ে শুধু মাত্র মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে আরডিএ কর্তৃপক্ষ নিয়োগ বোর্ড গঠন করে এই ১০জনকে নিয়োগ দিয়েছে। যা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির নিয়মবর্হিভুত। পরে এই মামলার তদন্ত করে দুদকের উপ-পরিচালক ফরিদুল রহমান ও শাহমখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফয়জুল হক। এই দুই কর্মকর্তা দীর্ঘ তদন্তের পর গত ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারী চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ জন কর্মচারিকে আরডিএ কর্তৃপক্ষ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তভঙ্গ করে বিধিবর্হিভুতভাবে বয়স শিথিল করে নিয়োগ দিয়েছে। আরডিএ’র চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বদলী হয়ে যাওয়ার শেষ কার্যদিবসে তিনি স্বাক্ষর করে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করে চলে যান। নিয়োগপ্রাপ্ত ১০ জন কর্মচারির বেতনভাতাদি বন্ধের কথা বলা হয়। নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে মতামতের জন্য প্রতিবেদন পাঠানো হয় আইন, বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ মতামত অধিশাখা-৩ এ।

তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ১০জন কর্মচারির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা চুড়ান্ত নিস্পতি না হওয়া পর্যন্ত তাদের সকল ধরনের সুবিধাদি প্রদান করা সমীচীন হবে না মর্মে মতামত দেন মন্ত্রণালয়। তারপরও আরডিএ কর্তৃপক্ষ সকল কর্মচারির বেতনভাতাসহ সকল সুযোগ সুবিধা অব্যাহত রেখেছে। একই সাথে যারা অবসরে গেছেন তাদেরকেও সকল সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

আরডিএ’র আইন অনুযায়ী মাস্টাল রোল থেকে কোনো কর্মচারি নিয়োমিত পদে নিয়োগ দেয়া হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন থাকতে হয়। কিন্তু আরডিএ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না নিয়ে তিনজন কর্মচারি নিয়োগ দেয়ায় ১৯৯৪-৯৫ সনের অগ্রিম অনুচ্ছেদ নং- ৩ এর ধারায় অডিট আপত্তি হয়। এই অডিট আপত্তির কারণে তাদের বেতনভাতাদি বন্ধের অফিস আদেশ হয়। এর প্রেক্ষিতে দুই কর্মচারি সার্ভেয়ার আবুল বাশার, ইমারত পরিদর্শক মনিরুজ্জামান হাইকোর্টের স্মরণাপন্ন হন।

পরে গত ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর হাইকোর্ট তাদের পক্ষে রায় দেন। দুইজন কর্মচারি হাইকোর্ট থেকে রায় নিয়ে এলেও তাদের বেতনভাদি চালু হয়নি। অথচ আরডিএ’র আইন কর্মকর্তা বদরুজ্জামান ও আইন উপদেষ্টা আব্দুল আজিজের সুপারিশে অপর কর্মচারি শহিদুল ইসলামের বেতনভাতাদি চালু হয়। কিন্তু অপর দুইজনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ আপিল করায় তাদের বেতনভাতাদি এখনো চালু হয়নি। তাদের মামলাও এখনো চলমান। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আরডিএ’র এস্টেট অফিসার ও আইন উপদেষ্ঠা বদরুজ্জামান কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপান। তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, আমাকে আরডিএ কর্তৃপক্ষ যা বলেছে আমি তাই করেছি। আমি কর্তৃপক্ষের বাইরে কিছু করিনি।

এদিকে মন্ত্রণালয়ের দুই অডিট আপত্তিতে ১৩ জন কর্মচারির বিরুদ্ধে মামলা চলমান। কিন্তু এরমধ্যে অডিট আপত্তি থাকার পরও আরডিএ কর্তৃপক্ষ ১১ জন কর্মচারিকে বেতনভাদি দিচ্ছে। আর দুইজন কর্মচারি একই অভিযোগে অভিযুক্ত থাকার পরও আরডিএ’র অদ্ভুত ভুতুড়ে আইনকানুনের জন্য দুই কর্মচারি বেতনভাতাদি থেকে বঞ্চিত।

এব্যাপারে আরডিএ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হায়াত মোঃ রহমতুল্লাহ্ বলেন, আরডিএ’র আইন অনুযায়ী আমি এই প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র নই। যার কারণে আমি বক্তব্য দিতে পারবো না। তবে বক্তব্য দিতে না চাইলেও তিনি বলেন, বিষয়টি আমি দেখবো।

এব্যাপারে গত রোববার (১২মার্চ) দুপুরে আরডিএ’র চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি মিটিংয়ে আছে বলে জানানো হয়। পরে আরডিএ’র চেয়ারম্যান জিয়াউল হকের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।