আয়কর কমছে চার সংকটে

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

গ্যাস ও বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে শিল্পের উৎপাদন কমছে। ডলার সংকটে কমেছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক পরিস্থিতিতে মুনাফা কমছে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। আর চলমান উচ্চমাত্রায় মূল্যস্ফীতির আঘাতে হ্রাস পেয়েছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।

ফলে গতি কমছে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির। এসবের বিরূপ প্রভাবে কমছে সরকারের আয়কর আহরণও। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় কমেছে প্রায় ২৭৫৯ কোটি টাকা।

আয়কর হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের বৈঠকে উঠে আসে। ওই বৈঠকে কাস্টমস কর, মূসক নিয়েও আলোচনা হয়।

এতে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জনের হার ৯১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে আয়করের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৯৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। তবে সর্বশেষ হিসাবে গত জুলাই-জানুয়ারি সাত মাসে আয়কর আদায় হয়েছে ৫৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় কম হয়েছে ২ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে আয়কর প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, বিষয়টি বৈঠকে উল্লেখ করে বলা হয়, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার বিষয়টি তদারকি প্রয়োজন।

আয়কর প্র্রসঙ্গে ওই বৈঠকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আয়কর আহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রবৃদ্ধি বিষয়েও নজরদারি করতে হবে। আয়কর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তদারকি করবেন।

জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, আয়কর কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ অভ্যন্তরীণ স্লো অর্থনীতি। মানুষের আয় না হলে কর দেবে কীভাবে। মূল্যস্ফীতি মানুষের এমনিতে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে দিয়েছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ঠিকমতো হচ্ছে না। কারণ কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে ডলার সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা। বৈরী পরিবেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মুনাফাও কমছে। এসব কারণে আয়কর কমছে। তার মতে, অর্থনীতি শক্তিশালী হলে মানুষের আয়-রোজগার বাড়বে, বেশি লোক করের আওতায় আসবেন। আবার শহর-গ্রাম নির্বিশেষে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সুষমভাবে বাড়তে থাকলে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে করদাতার সংখ্যা বাড়বে।

জানা যায়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ডলার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে ডলার সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। কাঁচামাল আমদানিতে একধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে শিল্পে উৎপাদনও ব্যাহত হয়।

এছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। তেল আমদানি ব্যয় কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়। ফলে উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের সংকটে পড়ে। একই অবস্থা দেখা দেয় গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রেও। ফলে ডলার সংকট, গ্যাস ও বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে শিল্পে উৎপাদন কমে যাওয়ায় তাদের আয়ও হ্রাস পায়।

এছাড়া পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফাও এ বছর কমেছে। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাজার মূলধনে শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে ৬টির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং সরকারের নীতির পরিবর্তনকে ইপিএস (আর্নিং পার শেয়ার) কমার কারণ হিসাবে দেখিয়েছে। পাশাপাশি মুনাফা কমেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও। ফলে এ বছর প্রত্যাশা অনুযায়ী করপোরেট কর আদায় হচ্ছে না।

এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়ন হার কম। যে কারণে সিমেন্ট ও স্টিল মিলের মুনাফায় একধরনের ধস নেমেছে। সংশ্লিষ্ট এক হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বড় সিমেন্ট ও স্টিল মিলের আয় হ্রাসের হার ১৪ থেকে ৯৫ শতাংশ। এসব কোম্পানিই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। বড় কোম্পানির আয় বেড়েছে, কিন্তু মুনাফা হ্রাস পেয়েছে। একই চিত্র ছোট-মাঝারি খাতেও। এসব খাত থেকে করপোরেট কর কমছে।

এদিকে পরিস্থিতি খারাপের কারণে কোম্পানি নিবন্ধনের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে কোম্পানি নিবন্ধনের সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৮২৬। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এ সংখ্যা ৬ হাজার ৫৭৬। নতুন নিবন্ধন হার হ্রাস পাওয়ায় এ খাত থেকে কমছে কোম্পানি কর।

মূল্যস্ফীতিও পরোক্ষভাবে আয়কর আয়ে আঘাত করেছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিুমুখী হলেও সর্বোচ্চ রের্কড সৃষ্টি করেছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে। এর নেতিবাচক প্রভাবে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে অনেক পরিবার। এমন পরিস্থিতি যে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত মাছ-মাংসের স্বাদ নিতে পারছে না। শাকসবজির দামও চড়া। এমনকি ভরা মৌসুমেও চালের দর চড়া। কোনো পণ্যের দামেই কোনো লাগাম নেই। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ে আয়কর খাতে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, আদায় বাড়াতে আয়কর কর্মকর্তাদের কর আহরণে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি আয়করবিষয়ক মতামত ও ভেটিংগুলো সম্পন্ন করা, আয়করের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত স্পষ্টীকরণের পদক্ষেপগুলো নেওয়া হবে। সূত্র:যুগান্তর