আমে দিশেহারা রাজশাহীর চাষিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর বানেশ্বর বাজার এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ আমের বাজার বলে পরিচিত। এখানে এখন গড়ে ১৫-২০ ট্রাক বেচা-কেনা হচ্ছে। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের মাঝখানের পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজারটিতে প্রতি বছরই কোটি কোটি টাকা আম বেচা-কেনা হয়। এ বছরও হচ্ছে। তবে আম হাটে প্রচুর পরিমাণে আসলেও দামের দিক দিয়ে রেকর্ড পরিমাণ কম মূল্যে আম কেনা-বেচা হচ্ছে। এতে করে যেসব আমচাষি আম বিক্রি করে মোটা টাকা পকেটে ভরেন প্রতি বছর তারা এবং যেসব আমচাষি আগেই আম বাগান লিজ অথবা চুক্তিতে আম লিনে রাখেন তারা হয়ে পড়েছেন দিশেহারা। দাম না পাওয়ায় অনেকেই গাছ থেকে আম পাড়ছেন না। ফলে গাছেই পেকে পেকে ঝরে যাচ্ছে বা গেছে আম। এভাবে হাজার হাজার আমচাষির বাগানে আম নষ্ট হয়েছে এবার। কিন্তু বাজারে চাহিদা না থাকায় গাছ থেকে পাড়তে পারেননি তাঁরা। অনেকেই তাকিয়ে আছেন আম শেষের দিকে। ঝরে পড়ার পরে অবশিষ্ট যা থাকবে-সেগুলোতেই হয়তো দাম পাবেন-এমন আশায় আম পাড়ছেন না এখনো।

বৃহস্পতিবার বানেশ্বর বাজার ঘুরে জানা যায়, গত বছর এই সময়ে যে আম প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে দুই হাজার থেকে ৩৫ শ টাকা দরে। এবার সেখানে বিক্রি হচ্ছে ৫০০-১৬০০ টাকা দরে। ফলে মণেই অন্তত ১৫০০ টাকা কম দরে আম বিক্রি করতে হচ্ছে চাষি ও ব্যবসায়ীদের। ঈদের কয়দিন আগে এর চেয়েও কম দাম আম বিক্রি করতে হয়েছে। কোনো কোন দিন আম বিক্রিই হয়নি শেষের দিকে। চাষিরা আম বিক্রি করতে এসে দাম না পেয়ে রাস্তার পাশে ঢেলে রেখে খালি হাতে বাড়ি চলে গেছেন এমন দিনও গেছে এবার। রোজা শুরু হওয়ার সপ্তাহ খানেকের মাথায় আমের দাম কমতে কমতে ২০০-৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হতে থাকে। এখন একটু বাড়লেও ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। যারা বছরজুড়ে এই সময়ে আমের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাঁরা একেবারে হতাশ। কেউ কেউ ঋণ নিয়ে আমচাষ করে পড়েছেন বিপাকে। এমনটিই জানান চাষি ও ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি ক্ষতিগ্রস্থ এসব চাষি ও ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরী করে সরকার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না করলে অনে অনেকেই সর্বশান্ত হয়ে পড়বেন।

গতকাল বানেশ্বর বাজার ঘুরে আরো দেখা গেছে, শত শত আমচাষিরা আম নিয়ে অপেক্ষা করছেন ক্রেতার জন্য। কিন্তু বাজারে যে পরিমাণ আম জড়ো হয়েছে সে পরিমাণ ক্রেতা নাই। ফলে আ বিক্রি করতে এসেও বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। আবার ক্রেতা পেলেও ইচ্ছে মতো দাম বলে যাচ্ছেন। ফলে চাষিদের চাহিদামত দামে আম বিক্রি হচ্ছে না।

ব্যবসায়ী ও আমচাষিরা জানান, গতকাল এই বাজারে প্রতি মণ লখনা জাতের আম বিক্রি হয় ৫০০-৬০০, হিমসাগর ১৪-১৮ শ ঠাকা, ও ল্যাংড়া ১৪০০-১৫০০ এবং ফজলি ৫০০-৬০০ টাকা মণ দরে। অথচ গতবার এই সময়ে এসব জাতের আম বিক্রি হয়েছে মণে অন্তত দুই হাজার টাকা দরে। গতকাল আ¤্রপালি বিক্রি হয়েছে ১৩-১৬শ টাকা দরে। কিন্তু গতবার এই সমেয় একই জাতের আম বিক্রি হয়েছে অন্তত ২৫ শ টাকা দরে। গতবার এই সময়ে লখনা জাতের আমও বাজারে ছিল না। কারণ গত বছর দাম ভালো থাকায় আগেই শেষ হয়ে যায় এ জাতের আম। তবে এবার আমের দাম একেবারে পড়ে যাওয়ায় চাষি ও ব্যবসায়ীরা বাগান থেকে এ জাতের আম এখনো অনেকেই পাড়েননি। ফলে এখনো লখনা এবং আঠি জাতের শত শত টন আম আসছে বাজারে।

এই হাটে জেলার দুর্গাপুরের আমচাষি আলতাফ হোসেন জানান, তিনি প্রতি বছর অন্তত ১৫ লাখ টাকার আম বিক্রি করেন। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত তিনি তিন লাখ টাকার আমও বিক্রি করতে পারেননি। অথচ আম প্রায় শেষের দিকে। বাগানেই এবার প্রচুর আম নষ্ট হয়েছে। আবার বাজারে আনলেও দাম পাওয়া যায়নি। কখনো কখনো শ্রমিক খরচ, গাড়ী ভাড়ার টাকাও উঠেনি আম বিক্রি করে। এ কারণে রাগ করে বেশকিছুদিন তিনি বাগানের আমই পাড়েননি। ফলে আম পোক্ত হয়ে গাছেই পেকে পেকে নষ্ট হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু দাম সেই হারে ওঠেনি। ফলে এবার সবমিলিয়ে তার বড়জোর ৩-৪ লাখ টাকার আম বিক্রি হবে। কিন্তু তাকে আমের বাগান লিজ বাবদই গুনতে হয়েছে অন্তত ৫ লাখ টাকা। এছাড়াও রয়েছে আমের পরিচর্যা খরচসহ শ্রমিক খরচ। সবমিলিয়ে এবার আমচাষ করে তাঁর অন্তত ৫লাখ টাকা লোকসান হবে। অথচ অন্যনান বার আমচাষ করেই তিনি বছর শেষে অন্তত ৩ লাখ টাকা লাভ করতে পারতেন। সেখানে এবার লাভ তো দূরের কথা, আমের বাগান লিজের খরই হয়তো উঠবে না।

একই দাবি করেন, চারঘাটের আমচাষি আকবর আলী। তিনি বলেন, ঋণ করে আমের বাগান লিজ নিয়েছিলাম ছয়মাস আগে। আশা করেছিলাম এবার যে হারে আম গাছে আছে-তাতে অন্তত ১০ লাথ টাকা লাভ হবে। কিন্তু লাভ কোথায়? এখন লোকসান গুনতে হবে অন্তত ৮লাখ টাকা। এই টাকা কিভাবে পরিশোধ করবো বুঝে উঠতে পারছি না।’

চারঘাটের আমচাষি মুনসুর আলী বলেন, সরকারের উচিত হবে, দ্রুত আমের দিকে নজর দেওয়া। এবার যে হারে কৃষক ও ব্যভসায়ীরা আমচাষ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন-তাতে আগামীতে তাঁরা বিমুখ হবেন। আর এটি হলে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কৃষক এবং আম ব্যবসায়ী ও শ্রমিক মিলে আমের ওপর নির্ভলশীল অন্তত কয়েক লাখ মানুষ। তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে।’

ব্যবসায়ীরা জানান, সরকারি নির্দেশণা মেনে গত ২০ মে থেকে রাজশাহী বানেশ্বর ও চাাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজারে আম কেনা-বেচা শুরু হয়। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই আমের বাজারে হঠাৎ নামে ধস। একটি কম্পানী গত বছর যে আঠি জাতের আম কিনেছে ৮০০-১২০০ টাক মণ দরে, তারাও এবার আম কিনেছে ২০০-৪০০ টাকা দরে। ফলে ওই কম্পানীর সিন্ডিকেটও আমের দামে ধস নামিয়ে দেয়। আবার ঢাকা, চট্টগ্রাম.সিলেট, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকাররাও এবার রোজার মধ্যে আম সেভাবে কেনেনি। ফলে বাজারে কখনো কখনো আম বিক্রি করারও লোক পাননি চাষিরা। এতে করে অতিতের সকল রেকর্ড ভঙ করে এবার আমের বাজারে নামে ধস। এর ফলে রাজশাহী অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা নেমে এসেছে বলেও দাবি করেন আমচাষিরা।

বানেশ্বর হাটের ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহীতেই গত কয়েক বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার আম বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এবার সেখানে ২০০ কোটি টাকার আম কেনা-বেচা হবে কিনা-সেটি নিয়েই আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এবার আমের বাজার একেবারে কম। এই দামে আম কতদিন আগে বাজারে বিক্রি হয়েছে মনে পড়ছে না।’

তিনি আরো জানান, এবার শুরুতেই অন্যান্য বারের মতো প্রতিমণ গোপালভোগ আম বিক্রি হয়েছে ১৫-১৮ শ টাকা, এবং গুটি জাতের আম ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা দরে। কিন্তু সপ্তাহ খানেক পরেই সেই আমের দাম নেমে আসে ১৫০-৪০০ টাকা মণ। রোজার কারণে এবং ঢাকায় ক্যামিকেলযুক্ত আম ধরা পড়ার পরে বাজারে মানুষের আতঙ্ক নেমে আসে। ফলে এবার আমের বাজারে ধস নামে বলেও দাবি করেন ওই ব্যবসায়ী। তিনি আরো বলেন, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাইরে একটি অঞ্চলের আম এবার আগে-ভাগেই বাজারে এসেছিল কেমিক্যালযুক্ত অবস্থায়। ওই আমেই বাজার নষ্ট করেছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলের চাষিদের। এবার আমচাষিদের যে ক্ষতি হচ্ছে-তাতে সরকার নজর না দিলে কোনো মতেই চাষিরা কাটিয়ে উঠতে পারবেন না বলেও দাবি করেন তিনি।

এদিকে রাজশাহীর ফল গবেষণা কার্যালয় সূত্র মতে, আমের রাজধানী রাজশাহীতে বেড়েই চলেছে আমের চাষ। গত কয়েক বছর ধরে রাজশাহীতে অব্যাহতভাবে বেড়েছে আমচাষ। এক হিসেব মতে, গত ছয় বছরে রাজশাহীতে আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে দ্বিগুন। সেইসঙ্গে উৎপদানও বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। পাশাপাশি বাড়ছে অর্থনীতির গতিও। এবারও রেকর্ড পরিমাণ আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এ বছর। চলতি বছর রাজশাহীতে আমের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে। যা এর আগে এতো পরিমাণ জমিতে আমচাষ কখনোই হয়নি। এ বছর ওই পরিমাণ জমি থেকে আম উৎপদানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন। এটিও স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা। আমগাছে যে পরিমাণ মুকুল এসেছে-তাতে এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে রেকর্ড পরিমাণ আম উৎপাদন হবে বলেও আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল আলীম জানান, হেক্টর প্রতি গড়ে ১৫ দশমিক ৫৮ মেট্রিক টন হারে আম উৎপাদন হবে বলেও এবারও আশা করা হচ্ছে। সেই হিসেবে এবার আমের উৎপাদন গতবারের চেয়ে অনেক বাড়বে। যা হবে সবচেয়ে বেশি আমের উৎপাদন। এবার গাছগুলোতে ব্যাপক পরিমাণ মুকুল লক্ষ্য করা গেছে। যা থেকে প্রচুর পরিমাণে আম এসেছে। সামনে যে কয়দিন সশময় আছে এই সময়ে মধ্যে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে এবারও রাজশাহীতে সর্বোচ্চ আম উৎপাদন হবে। ’

স/আর