আমার সন্তানদের বাঁচাও, তোমরা এখান থেকে পালিয়ে যাও’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

গত শুক্রবার মিয়ানমারের মংডু এলাকার বাড়ির পাশে জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ ইয়াছিন। মসজিদে প্রবেশ করবেন—এমন মুহূর্তে বাড়িতে দাউদাউ আগুন দেখে দৌড়ে বাড়িতে চলে আসেন ইয়াছিন। এসে দেখেন ঘর জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তখন তিনি স্ত্রী সনজিদা খাতুনকে বলেন, ‘চলো এখানে আর থাকা যাবে না। কিছু নিতে হবে না, সন্তানদের নিয়ে চলে যাব। ’ স্ত্রী ও তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে দৌড়াতে থাকেন ইয়াছিন-সনজিদা দম্পতি। দুই শিশুসন্তান হাঁটতে পারে। একজনকে কোলে নিয়ে ছুটছিলেন ইয়াছিন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গুলিতে একপর্যায়ে ইয়াছিন গুলিবিদ্ধ হন। ইয়াছিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সময় সনজিদাকে বলেন, ‘আমার সন্তানদের বাঁচাও। তোমরা এখান থেকে পালিয়ে যাও।

প্রিয় স্বামীর নিথর দেহ ওভাবেই ফেলে রেখে তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে দৌড়ে পালাতে থাকেন সনজিদা। গত দুই দিন কয়েক মাইল (মিয়ানমার) হেঁটে অবশেষে গতকাল রবিবার সকাল ১০টায় মিয়ানমার সীমান্ত পার হয়ে কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে কক্সবাজার কুতুপালং এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করতে করতে সনজিদা কালের কণ্ঠকে বলছিলেন, ‘আমাদের গ্রামটিতে এখন কোনো লোক নেই। যার সঙ্গে আজকে ১০ বছর ধরে সংসার করেছি ওই লোকটাকে (স্বামী ইয়াছিন) তারা (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) হত্যা করেছে। স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে মারা গেছে। কাঁদার সময়ও পাইনি। বাবাহারা এই অবুঝ শিশুসন্তানদের নিয়ে আমি কোথায় যাব। তাদের কিভাবে বাঁচাব?’

উখিয়ার কুতুপালং বাজার এলাকার পাশে বালুখালী এলাকায় সড়কে অবস্থান নেওয়া নুর হাসিনা (২৭) নামে অপর এক রোহিঙ্গা নারী গতকাল বিকেল ৪টার দিকে এ প্রতিবেদককে বলেন, তিন দিন ধরে রাখাইনের বলিরপাড়া এলাকায় এক দল যুবক মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলছে, ‘তোমরা বাংলাদেশে চলে যাও, এখানে কাউকে রাখব না। তোমাদের ঠিকানা বাংলাদেশ। কেউ বাঁচাতে পারবে না। না গেলে এখানে মরতে হবে। ’ নুর হাসিনা আরো বলেন, ‘গত বুধবার রাতে আমার স্বামীকে বাড়িতে (খালেদ হোসেন) গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ অবস্থায়ই এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আজ (গতকাল) দুপুর ১২টার দিকে এখানে (বালুখালী) এসেছি। তারা কত বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। মারার পর তারা লাশগুলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানি না। তাদের গুলিতে স্বামী মারা যাওয়ার পর মৃত স্বামীর দিকে ফিরে তাকাতে পারিনি। যেভাবেই হোক সন্তানদের বাঁচাব—এই ভেবে পালিয়েছি। ’

কুতুপালং ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় হালিমা বেগম (৫০) বলেন, ‘আমরা মংডু বলিবাজার এলাকা থেকে শনিবার রাতে এখানে এসেছি। আজ ভাত খেয়েছি সাত-আট দিন পর। তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে কিছু খাওয়াতে পারিনি। আজকে (গতকাল) সকালে এখানে (কুতুপালং) এসে সবাই একটু পানি খেয়েছি। কোনো ত্রাণ পাইনি। বেঁচে এখানে এসেছি, এটাও বেশি। ’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে না আসার কারণে আমার বড় ভাই নুর বশরকে ওরা (মিয়ানমারের এক দল সন্ত্রাসী) বোমা মেরে হত্যা করেছে। ’

হালিমার মেয়ে আজেদা বলেন, তাঁর সামনেই তাঁর স্বামী কামাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করেছে গত বুধবার রাত ১২টার দিকে। আজেদা বলেন, ‘স্বামীর লাশ কোথায় তা-ও দেখতে পারিনি। আমার তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে এখন কোথায় যাব। ’

রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ওই রাজ্যে গ্রামের পর গ্রাম শূন্য হয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত হামলা ও গণহত্যা অব্যাহত আছে। অসমর্থিত সূত্রে শোনা যাচ্ছে, যারা এখনো বিক্ষিপ্তভাবে সেখানে (মিয়ানমারে) আছে, তাদের আগামীকালের মধ্যে দেশ ছাড়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবারের মধ্যে না এলে আবারও হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নসহ অমানুষিক নির্যাতন চালানো হবে। এই ভয়ে নিজেদের সহায়-সম্বল ও বাপ-দাদাদের ভিটাবাড়ি ফেলে তারা এ দেশে পালিয়ে আসছে।

কক্সবাজার সদর থেকে উখিয়ার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। উখিয়া স্টেশন থেকে কিছুদূর গেলে প্রধান সড়কের দুই পাশে ও রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। এ ছাড়া সড়কের পাশে পাহাড় ও টিলার পাদদেশে প্লাস্টিক দিয়ে ছোট ছোট ঝুপড়ি বানিয়েছে রোহিঙ্গারা। এরপর সড়কের মধ্যে লাখো রোহিঙ্গার অবস্থানের কারণে গতকাল দুপুরের পর থেকে সেখানে গাড়ি চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এ কারণে দীর্ঘ পথ যানজটেরও সৃষ্টি হয়েছে। সড়ক থেকে রোহিঙ্গাদের সরানোর জন্য মাইকিং করা হলেও তাতে কেউ সরে যাচ্ছে না। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রোহিঙ্গারা সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে।