আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো উৎস সৌরশক্তি

হাঁটি হাঁটি পা পা করে সৌরবিদ্যুৎ বাংলাদেশে অনেকটাই এগিয়েছে। ২০০৭-০৮-এ জনগণের মাত্র ৪৫ শতাংশের কাছে বিদ্যুতের সংযোগ পৌঁছেছিল। প্রত্যন্ত জায়গায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এ জায়গাগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার জন্য সৌরবিদ্যুতের চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়।

প্রথম দিকে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো ছিল ব্যাটারিভিত্তিক ছোট ছোট সোলার হোম সিস্টেম, যা সন্ধ্যার পর দু-চারটি লাইট আর ফ্যানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০০৮ সালে সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি গ্রহণ করে। স্থির হয়, ২০১৫ সাল নাগাদ আমাদের শক্তিচাহিদার ৫ শতাংশ এবং ২০২০ সাল নাগাদ ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য খাত থেকে আসবে। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি মূলত অর্থনৈতিক কারণে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির দাম তুলনামূলক অনেক বেশি। উৎসগুলোর মধ্যে আছে সৌরশক্তি, বায়ু, খরস্রোতা নদী, সমুদ্রস্রোত, ভূতাপীয় (জিও থার্মাল) শক্তি ইত্যাদি। এই উৎসগুলোর প্রাপ্যতা দেশভেদে ভিন্ন হয়। যেমন—ভলকানিক জোনে থাকে ভূতাপীয় শক্তির সম্ভাবনা। এটা কমবেশি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে এমন অঞ্চলে কার্যকর, যেমন—ফিলিপাইন, আইসল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, এল সালভাদর ও জাপানের মতো দেশ। মাটির চার কিলোমিটারের মতো গভীরে তাপ ২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি হতে হবে। ওই স্তরগুলো সাধারণত পাথুরে ও উত্তপ্ত হয়। সেখানে পানি প্রবেশ করানো হলে তা বাষ্প হয়ে যায়। ওই বাষ্পের শক্তিতে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আমাদের দেশের তিনটি জায়গার সমীক্ষার ফল আমি দেখেছি, তাতে মাটির চার কিলোমিটার গভীরে তাপমাত্রা ১৫০ ডিগ্রিরও কম। খনন করে এর বেশি নিচে যাওয়া প্রযুক্তি ও ব্যয়ের দিক থেকে বাস্তবসম্মত নয়। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সমুদ্রস্রোতের বিষয়টি বৈশ্বিক পর্যায়েই খুব প্রয়োগ হয়নি। তারপর রয়েছে জলবিদ্যুৎ। পাহাড়ি অঞ্চলে জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা থাকে। আমাদের পাহাড়ি নদী তেমন নেই। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে হয়তো আমরা আর বেশি হলে ১০০ মেগাওয়াট যোগ করতে পারব। ‘ক্যাসকেডিং’ প্রক্রিয়ায় উজানে আরেকটা প্রকল্প নিলে আবার কাপ্তাইয়ে উৎপাদন কমে যাবে। জলবিদ্যুতের পরিবেশগত প্রভাবের দিকও আছে। দেশের অন্য জায়গায় হয়তো ছোট কিছু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হতে পারে। যেমন—সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নদীগুলোতে। কাজেই ধরা যায়, জলবিদ্যুৎ থেকে বড়জোর আর ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ মেগাওয়াট আসা সম্ভব। উপকূলীয় এলাকায় বায়ুবিদ্যুতের কিছু সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা বড় আকারের বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারিনি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতায় সৌরশক্তিই নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে ভালো উৎস।

আমাদের সৌরশক্তির প্রাপ্যতা সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম অঞ্চলে। যত বিষুবরেখার দিকে যাবেন সূর্যের কিরণ তত খাড়াভাবে পড়বে। সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অনেকটা জায়গা লাগে। এই কাজে কৃষিজমি ব্যবহার না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যেমনটা রয়েছে কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রেও। আমাদের দেশে পতিত বা অনাবাদি জমি তুলনামূলক উত্তরাঞ্চল, নদীর তীরবর্তী চর ও সাগরের মোহনা এলাকায় বেশি। তাই এসব অঞ্চলে বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের পরিকল্পনা হচ্ছে। নেট মেটারিংয়ের আওতায় বাংলাদেশে রুফটপ সৌরবিদ্যুতেরও একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।

দেশে সৌরশক্তির বিষয়টি এগিয়ে নিতে সোলার এনার্জি রোডম্যাপের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এটি এখন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনাধীন।  ২০১৭ সালের আগস্টে দেশে প্রথম জাতীয় গ্রিডে সৌরবিদ্যুৎ যুক্ত হয়। সেটা ছিল সৌরশক্তির বিকাশে এক উজ্জ্বল মাইলফলক।

আমরা চাই বা না চাই, বিশ্বের ভবিষ্যৎ যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক হবে তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। যারা আগে শুরু করবে তারা এগিয়ে থাকবে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বলব, এখনই যেসব শিক্ষার্থী এ নিয়ে পড়াশোনা করবে তারা এগিয়ে থাকবে। আমি যখন ২০০৪ সালে জার্মানিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে পড়তে গিয়েছিলাম তখন এ বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা ছিল না। পিডিবিতে চাকরির সুবাদে লক্ষ করেছিলাম, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া উত্তোলনযোগ্য অন্য কোনো জ্বালানি নেই বললেই চলে। গ্যাসের মজুদও সীমিত। তখনই মনে হয়েছিল, নবায়নযোগ্য জ্বালানিই হতে পারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

আমাদের সোলার প্যানেল, সেল, ব্যাটারি বা অন্য কোনো যন্ত্র উপকরণ উদ্ভাবন নিয়ে মৌলিক গবেষণার সুযোগ সীমিত। আমাদের চাই প্রয়োগিক গবেষণা। আমাদের হাতে যা আছে তা কিভাবে আরো দক্ষতার সঙ্গে, স্বল্প খরচে আমাদের দেশের জন্য কাজে লাগানো যায় তা দেখতে হবে।

জার্মানিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে পড়ার সময় মনে হলো, দেশে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার দরকার। পড়া শেষে দেশে এসে পিডিবির চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই। উপাচার্য মহোদয়কে দুটি শর্ত দিয়ে আমি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন আমার বুয়েটের শিক্ষক। প্রথম শর্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা। এভাবে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর কোর্স শুরু হলো। দ্বিতীয় শর্ত ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে কাজ করতে একটি প্রায়োগিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা। একটু একটু করে গবেষণাগারের কাজ শুরু করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্প বরাদ্দের পাশাপাশি নিজেও তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকি। জার্মানির স্কলারশিপের সুবাদে কিছু ফান্ড পেলাম। দেশে টেকনিক্যাল অডিট জাতীয় ইডকলের কিছু কাজ করে কিছু অর্থ আসে। কিছু কিছু করে ছাত্রও এলো। এখন দেশের সৌরবিদ্যুৎ খাতে কাজ করা পেশাজীবীদের বড় একটা অংশই আমার ছাত্র, শিক্ষার্থী বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী ও টেকনিশিয়ানকে আমরা সৌরবিদ্যুতের ওপর কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়েছি।

দেশে এখন অনেক সোলার মিনি গ্রিড তৈরি করে তা দিয়ে অফ গ্রিড এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ নেই এমন এলাকায় বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য তা কাজে লাগছে। অনেকে দাম বেশি বলে এর বিপক্ষে কথা বলেন। কিন্তু এমন জায়গার কথা ভাবুন, সন্ধ্যা হয়ে গেলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছু আর করার নেই। কুপি, হারিকেন দিয়ে আর কতক্ষণ চলে? সৌরবিদ্যুতের আলোয় এখন এ রকম প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। গ্রাম যেন সত্যিই শহর হয়ে গেল। প্রত্যন্ত গ্রাম, চর ও দ্বীপাঞ্চলের লোকও এখন সৌরবিদ্যুতের সুবাদে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। জীবনধারাই বদলে গেল না?

বর্তমানে সৌরবিদ্যুতের অনেক বড় বড় প্রকল্প পরিকল্পনা বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ২০২৪ সাল নাগাদ প্রায় ১০০০ মেগাওয়াটের ওপর সৌরবিদ্যুৎ আমাদের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে, যা উত্তরোত্তর বাড়বে।

মিনি গ্রিডের উদ্যোক্তাদের একটা সমস্যার কথা বলে শেষ করব। প্রত্যন্ত অফ গ্রিড এলাকায় বিদ্যুতায়নের জন্য বেসরকারি উদ্যোগে (যেখানে সরকারি আর্থিক অনুদানও ছিল) সোলার মিনি গ্রিড স্থাপন করা হয়েছিল, যা সরকারের বিদ্যুতায়ন পরিকল্পনারই অংশ ছিল। এখন এসব এলাকায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ লাইন যাওয়ায় সোলার মিনি গ্রিডের উদ্যোক্তারা পড়েছেন সমস্যায়। বেশি দামে তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেউ কিনবে না। সরকারের সৌরবিদ্যুিবষয়ক গাইডলাইনে উল্লেখ ছিল, এ রকম হলে সরকার মিনি গ্রিড থেকে সৌরবিদ্যুৎ কিনে নেবে। উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ওপর বছরে ১৫ শতাংশ লাভ ধরে ট্যারিফ নির্ধারণ করা হবে। মিনি গ্রিডের অপারেটররা চাইছে সরকার যেন ন্যায্য মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে নেয়। সরকারের উচিত দ্রুত ট্যারিফটা চূড়ান্ত করা। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক উদ্যোক্তা ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন। বর্তমানে অপারেশনাল ২২টি সোলার মিনি গ্রিডের উৎপাদনক্ষমতা সাকল্যে মাত্র পাঁচ মেগাওয়াট, যা এমন বেশি নয়।

লেখক : নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, পরিচালক, সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর রিনিউয়েবল এনার্জি সার্ভিসেস লিমিটেড

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ