আমরা নিজেরাই এখন রোহিঙ্গা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

‘বাংলাদেশি’ না ‘রোহিঙ্গা’—চোখের দেখায় চেনা কঠিন। কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির থেকে উখিয়া বাজারে যাওয়ার পথে বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশের দুটি চেকপোস্ট পার হতে হয়। এই চেকপোস্ট দুটির কাছেই বিশ্বের বৃহত্তম আশ্রয়শিবির এবং এর আশপাশে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার একর জমিতে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় স্থায়ী বাসিন্দা সাড়ে পাঁচ লাখ। প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় বাসিন্দারা এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। এই রোহিঙ্গারা কবে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কি না তাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে।

গত শনিবার দুপুরে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের প্রবেশমুখে ভাসমান এক ফল বিক্রেতার কাছে ‘বাংলাদেশি না রোহিঙ্গা?’ পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেই জবাব দেন, ‘আমরাই এখন রোহিঙ্গা হয়ে গেছি।’

মো. সুলেমান নামের উখিয়ার এই স্থায়ী বাসিন্দা জানান, তিনি তাঁর ছোটবেলা থেকে রোহিঙ্গাদের এ দেশে আসতে দেখছেন। এই যন্ত্রণা আর কত? তিনি বলেন, ‘যে জমি চাষ করতাম, সেটাসহ মা-বাবার কবরের জায়গা সবই গেছে রোহিঙ্গাদের দখলে। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে যে রোহিঙ্গা ঢল তা ভয়াবহ। কিছু লোক হয়তো এনজিওগুলোকে বাড়িভাড়া দিয়ে লাভবান হয়েছে। তবে বেশির ভাগই এখন হিমশিম খাচ্ছে।’

গত সপ্তাহে উখিয়া বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক বছর আগেও উখিয়াতেই ছিল বড় বাজার। কিন্তু সেই জৌলুস এখন আর নেই। কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের সামনে ও ভেতরে বড় বাজার বসে। রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতর স্বর্ণালংকার, প্রসাধনী থেকে শুরু করে সব পণ্যেরই দোকান আছে। ওই দোকানগুলোর ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই রোহিঙ্গা। শিবিরের ভেতর ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জীবন-জীবিকা ঘিরে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।

মানবিক সহায়তা হিসেবে বিদেশ থেকে যে কোটি কোটি টাকা আসে তার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয় রোহিঙ্গা শিবিরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সামনে দিয়ে দেশি-বিদেশি এনজিও ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার শত শত গাড়ি রোহিঙ্গা শিবিরে যাতায়াত করে। মানবিক সহায়তার কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত দেশি কর্মীদের বড় অংশই উখিয়া ও টেকনাফের বাইরের। এমনকি রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিওগুলো স্থানীয়দের বাদ দিয়ে রোহিঙ্গাদের কাজ দিচ্ছে। তাই চাকরির ক্ষেত্রে বঞ্চনার জোরালো অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় বাসিন্দারা। এনজিওকর্মীদের প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়ে গত সোমবার মাঠেও নেমেছিল তারা।

এরপর উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান এক ফেসবুক বার্তায় স্থানীয় বাসিন্দাদের বলেছেন, তাদের সব যৌক্তিক দাবির সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন সব সময় একমত। এনজিওগুলোতে চাকরিসহ স্থানীয় জনসাধারণকে সহায়তার জন্য উপজেলা প্রশাসন সর্বোচ্চ সচেষ্ট রয়েছে।

মো. নিকারুজ্জামান গত শনিবার সকালে তাঁর নিজ দপ্তরে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোতে নিয়োগ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহ-শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে দুটি এনজিওর নিয়োগ পরীক্ষা উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে উখিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।’

কয়েকটি এনজিওর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা স্থানীয় চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন লোক পান না। এমনকি স্থানীয় আবেদনকারীর সংখ্যাও থাকে কম।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশে স্থানীয়রা দোকান খুললেও সেখানে কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। আবার এনজিওগুলোও কম বেতনে কর্মী নিয়োগের অজুহাতে রোহিঙ্গাদের কাজ দিচ্ছে।

উখিয়ার বালুখালী পানবাজারে গত শুক্রবার সকালে এসএম মেডিক্যাল হল নামে একটি ফার্মেসিতে মো. শাকের নামে এক রোহিঙ্গাকে ওষুধসামগ্রী বিক্রি করতে দেখা যায়। মাসে আট হাজার টাকা বেতনে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সেখানে কাজ করা রাখাইনের মংডুর কৈলাবা গ্রাম থেকে বাস্তুচ্যুত ওই ব্যক্তি জানান, তাঁর ভাইও রোহিঙ্গা শিবিরে একটি এনজিওতে মাসে ২৪ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এনজিওগুলো দিনমজুর হিসেবে রোহিঙ্গাদের চাকরি দিয়ে মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকাও বেতন দিচ্ছে। স্থানীয় এক কর্মকর্তা অবশ্য এনজিওতে চাকরি নিয়ে স্থানীয়দের নানামুখী সমস্যার কথাও জানান। তাঁর তথ্য অনুযায়ী, এনজিওগুলোতে চাকরি বা বেশি বেতনের প্রলোভনে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুদের জন্য যখন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে তখন স্থানীয় শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপবৃত্তির আওতায় আনা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যার ২০-২৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরির যোগ্যতা নেই, সেও এর চেয়ে বেশি বেতনে বিভিন্ন এনজিওর চাকরিতে ঢুকছে। এনজিওগুলোর প্রকল্পের মেয়াদ শেষে তারা কম বেতনেও চাকরি পাচ্ছে না বা কম বেতনে চাকরি করতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ছে।

জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের উপস্থিতির কারণে উখিয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এনজিওগুলো স্থানীয় লোকজনের ধানি জমি, পাকা ঘর—সবই ভাড়া নিয়ে অফিস কার্যক্রম চালাচ্ছে। উখিয়ায় রাস্তার দুই পাশের পাকা ঘরগুলো এখন এনজিওর অফিস। বাড়িভাড়া, পরিবহন ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে।

এইচ ডি মিলন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘উখিয়ার জামতলীর পনেরো নম্বর শিবিরে রোহিঙ্গাদের চাকরি থেকে শুরু করে চাল, ডাল, তেল সব দেওয়া হচ্ছে। এনজিওগুলো আবার রোহিঙ্গাদের দিয়ে দিনমজুরের কাজও করাচ্ছে। আমার এলাকায় অসহায় দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ কী করবে?’

উখিয়ার মধুরছড়ায় রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে আবুল কালাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা ও তাঁর স্বজনদের কয়েকটি বাড়ি পড়েছে। আবুল কালাম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানান, চারপাশে রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে তাঁরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। বনের গাছপালা, পাহাড় কেটে উজাড় করা হচ্ছে। যে জমিগুলোতে তাঁরা ফসল ফলাতেন সেগুলোর বেশ কটিই এখন রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। কোনো অনুমতি ছাড়াই রোহিঙ্গারা এখন সেখানে চাষাবাদ শুরু করেছে। তাঁদের বাড়িতে আসার রাস্তাটি রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে পড়েছে। সন্ধ্যার পর সেদিক দিয়ে আসতে গেলে রোহিঙ্গারা বাধা দেয়।

তিনি জানান, রোহিঙ্গারা পাখি ধরার জন্য ফসলের ক্ষেতে বিষ দিয়েছিল। আর সেই বিষ খেয়ে তাঁর ১০ থেকে ১২টি মুরগি মরে গেছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও ফল হয়নি। গরু চরাতেও এখন নিরাপদ বোধ করছেন না তাঁরা।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার জন্য জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থা ও সহযোগী বেসরকারি সংস্থাগুলো এ বছর যে ‘যৌথ সাড়াদান কর্মসূচি’ (জেআরপি) প্রণয়ন করেছে তাতে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের সহায়তার জন্য মোট ৯২ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় সাত হাজার ৭২৬ কোটি টাকা) চেয়েছে। ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, উখিয়ায় এনজিওকর্মীদের প্রতি স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। বিষয়টি মানবিক সহায়তা প্রক্রিয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের আরো সম্পৃক্ত করার গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছে।