আবাসনে গতি ফেরাতে বহুমুখী উদ্যোগ রিহ্যাবের

করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকটা থমকে ছিল আবাসনখাত। কিছুতেই বাড়ছিল না গতি। দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে আবাসনখাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পায় রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন ফি কমানো, প্রশিক্ষণ, কনস্ট্রাকশন বিদ্যুৎ রেট কমানোসহ রিহ্যাবের নানা পদক্ষেপে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে আবাসনখাত। যদিও নির্মাণসামগ্রীর অতিরিক্ত দাম এরই মধ্যে আবার হয়ে দাঁড়িয়েছে গলার কাঁটা।

অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে কোনো প্রশ্ন না ওঠায় এর মাধ্যমে দেশে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। এর বড় একটি অংশের বিনিয়োগ আবাসনখাতে। এতে একদিকে যেমন অর্থপাচার কমে আসছে, অন্যদিকে মহামারির মধ্যে আবাসনশিল্প বড় ধরনের ধসের হাত থেকে রক্ষা পায়, অভিমত এ খাত সংশ্লিষ্টদের।

আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, আবাসনখাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় প্রচুর টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে এ খাতে। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছর ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি মূল অর্থনীতিতে ফিরে এসেছে। সরকার ট্যাক্স পেয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। আবাসন ব্যবসায়ীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পর্যটনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এছাড়া কক্সবাজারে বিপুল সংখ্যক হোটেল-মোটেল তৈরি হওয়ায় প্রতি বছর পর্যটকের আগমন বাড়ছে।

তারা আরও বলেন, পর্যটনের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে জনগণ এবং প্রশাসনকে সচেতন করতে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে মতবিনিময়-সেমিনার অব্যাহত রেখেছে রিহ্যাব। আবাসনখাতে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের ভুঁইফোড় কোম্পানি গড়ে ওঠে, যারা ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট-প্লট ক্রেতাদের বুঝিয়ে দিতে পারেন না। এতে সুনাম ক্ষুণ্ণ হয় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের। এ বাধা দূর করতে ব্যবসায়ীরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আবাসন-শিল্পে ভুঁইফোড় কোম্পানির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করা হয়। যেখানে উল্লেখ রয়েছে, রিহ্যাব মেম্বার ছাড়া কেউ রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করতে পারবে না। এটাকে বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন এ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। মূলত আবাসন ব্যবসার সবাইকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে এসে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার পরিবেশ নিশ্চিত করতে রিহ্যাব বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে আসছে।

jagonews24

এছাড়া সদস্য ডেভেলপার কোম্পানির ন্যূনতম পেইড-আপ ক্যাপিটাল এক কোটি টাকায় উন্নীত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে ডেভেলপারদের প্রতি আস্থা বেড়েছে ও আবাসন ব্যবসায় ফিরে এসেছে সুনাম। অনেক কোম্পানি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের প্রজেক্টের কাজ শেষ করতে পারছে এবং আগের চেয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কও উন্নত হচ্ছে।

আবাসনখাতের উন্নয়নে রিহ্যাব শুরু থেকেই নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে তারা সেল গঠন, ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাসহ নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর বাইরে তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে এ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও গ্রাহকের সুবিধার্থে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে আসছে।

রিহ্যাব মেডিয়েশন সেল
রিহ্যাবের ভাবমূর্তি বাড়ানোসহ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ২০০৪ সালে ‘রিহ্যাব মেডিয়েশন সেল’ গঠন করা হয়। মেডিয়েশন অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস স্ট্যান্ডিং কমিটি আস্থা, সুনাম ও ন্যায্যতার সঙ্গে এ সেল পরিচালনা করে আসছে।

২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত ‘রিহ্যাব মেডিয়েশন সেল’ ১ হাজার ১০০’র বেশি রিয়েল এস্টেট বিরোধ সুষ্ঠু ও চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করেছে বলে জানা যায়। ভূমি মালিক ও গ্রাহকরা যাতে একে অপরের বিরুদ্ধে অযথা হয়রানি ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আনতে না পারে সেজন্য তারা প্রথমবারের মতো ‘অভিযোগ ফি’ দেওয়ার বিধানও চালু করেছে। অভিযোগ ফি চালুর পর হয়রানি ও ভিত্তিহীন অভিযোগ অনেকটাই কমে এসেছে।

কমেছে নিবন্ধন ব্যয়
নিবন্ধন ব্যয় বেশি থাকায় ফ্ল্যাট-প্লট বিক্রির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে অনেকে ফ্ল্যাট নিবন্ধন করতে চাইতেন না। এতে ভবিষ্যতে ফ্ল্যাটের মালিকানা নিয়ে তৈরি হতো নানা ধরনের আইনি জটিলতা। রিহ্যাবের অব্যাহত অনুরোধে সরকার আবাসন সেক্টরে নিবন্ধন ব্যয় ৩ শতাংশ কমায়। নিবন্ধন ব্যয় কমানোর কারণে বর্তমানে সে অবস্থা থেকে অনেকটাই উত্তরণ ঘটেছে। নতুন করে ব্যয় আরও কমানোর ব্যাপারে রিহ্যাবের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানা যায়।

jagonews24

সরল সুদে মিলছে গৃহঋণ
দেশে আবাসনখাতে আগের তুলনায় গৃহঋণের সুদহার কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ অন্য তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বৈঠক করে রিহ্যাব। পরে তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে গৃহঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয় এবং তা কার্যকর করে। পরে সরকারের আদেশে বর্তমানে প্রায় সব ব্যাংকই এক অঙ্কের সুদে গৃহঋণ দিচ্ছে।

গৃহায়ন খাতে অর্থায়ন করা সরকারি প্রতিষ্ঠান হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে ফান্ডের অভাবে ফ্ল্যাট-প্লট কিনতে ঋণ পাওয়া অনেক কঠিন ছিল আগে। কিন্তু রিহ্যাবের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাউজ বিল্ডিং করপোরেশনের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো হয়। তারা এখন সরল সুদে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সহজেই গৃহঋণ দিচ্ছে।

শ্রমিক-কর্মকর্তা-প্রকৌশলীদের দক্ষ করতে হয়েছে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট আবাসনখাত সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মকর্তা-প্রকৌশলীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে ‘রিহ্যাব ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথমে পান্থপথে ইনস্টিটিউটের অফিস নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে মিরপুর মাজার রোডে এর কার্যক্রম চলমান। এরই মধ্যে এই ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে প্রায় ১৬ হাজার শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়েছেন। প্রশিক্ষণ শেষ করা এসব শিক্ষার্থীর প্রায় ৯০ শতাংশের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানা যায়।

রিহ্যাব জানায়, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করতে প্রথমে ১৫ কাঠা জায়গা বরাদ্দ দেয় সরকার। রাজধানীর উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরে ‘কে ব্লকে’ এ জমি বরাদ্দ দেয় রাজউক। পরে ওই বরাদ্দ দেওয়া জমি সংলগ্ন আরও ৯ কাঠা জমি রাজউক থেকে বরাদ্দ পেতে ব্যাপক তৎপরতা চালায় রিহ্যাব। পরে সেটা পাওয়ার পর সেখানে ১৫ তলা আধুনিক ভবন নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেছে সংগঠনটি।

jagonews24

বৈদেশিক শ্রমবাজারে নির্মাণশ্রমিক পাঠাতে সহযোগিতা

এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) অর্থায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প- স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (এসইআইপি) সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রিহ্যাব। রিহ্যাব ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আউটসোর্সিং করা ইনস্টিটিউটগুলোর মাধ্যমে পাঁচটি ট্রেডে ২১ হাজার নির্মাণশ্রমিককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই প্রশিক্ষিত দক্ষ নির্মাণশ্রমিক বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট সেক্টরের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বৈদেশিক শ্রমবাজারেও যুক্ত হচ্ছে বলে রিহ্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

রিহ্যাবের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে কথা হয় সংগঠনটির সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজলের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতার মধ্যে বন্ধন তৈরি করতে চাই। যার মাধ্যমে সবার মৌলিক চাহিদা আবাসন নিশ্চিত হবে। আমাদের রিহ্যাব মেম্বারদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, বিদ্যুতের ‘কনস্ট্রাকশন রেট’ কমানো। বিদ্যুতের কনস্ট্রাকশন রেট ছিল বাণিজ্যিক রেটের দ্বিগুণ। আমরা বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, ডেসকো, ডিপিডিসি, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিসহ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে দফায় দফায় এ নিয়ে বৈঠক করেছি।

তিনি বলেন, আমরা দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়েছি। কমিশন নির্মাণশিল্পের জন্য একটি ‘স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ রেট’ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এতে আগের তুলনায় বিদ্যুৎ বিল প্রায় ৫০ শতাংশ কমে এসেছে। অফ-পিক আওয়ারে তা আরও কম। বিভিন্ন সময় নির্মাণসামগ্রীর মূল্য অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে রড, সিমেন্ট, ইটের মূল্যবৃদ্ধি ছিল অকল্পনীয়। নির্মাণ-সামগ্রীর দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে রিহ্যাবের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।

রিহ্যাব সভাপতি আরও বলেন, ‘ডিজিটাল রিহ্যাব’ গড়ার প্রত্যয়ে রিহ্যাবে তথ্য-প্রযুক্তি শাখা খোলা হয়েছে। রিহ্যাব সচিবালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রম আধুনিক ও গতিশীল করার লক্ষ্যে তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

শামছুল আলামিন কাজল আরও বলেন, রিহ্যাব আয়োজিত মেলাগুলোতে রাজউকের সহযোগিতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। রাজউকের মোবাইল কোর্ট ভিজিল্যান্স টিম হিসেবে মেলা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করে রিহ্যাব। ফলে ক্রেতা সাধারণের মেলার প্রতি আস্থা ফিরে এসেছে। তাছাড়া রিয়েল এস্টেট সেক্টরের প্রতিটি ক্ষেত্রে রিহ্যাব ও রাজউক একযোগে কাজ করছে বলে জানান তিনি।

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ