আবারও গোদাগাড়ীতে টমেটো বীজ নিয়ে প্রতারণা-পথে বসবে হাজারো কৃষক

আব্দুল বাতেন:
যে কৃষক বাংলার সোনার মাটিতে ফসল ফলিয়ে অর্থনীতির চাকাকে চাঙ্গা রাখছে সেই কৃষকদের সাথে যেন প্রতারণা বন্ধই হচ্ছে না। যুগ যুগ ধরে এদের প্রতি দমন-নিপীড়ন ও প্রতারণা করে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করে চলেছে। হচ্ছে কোটি পতি হচ্ছে সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এবারও রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার টমেটো চাষিদের সাথে বীজ নিয়ে প্রতারণার খেলা খেলেছে মেসার্স বন্ধু বীজ ভান্ডার।

মেসার্স বন্ধু বীজ ভান্ডারের প্রোপাইটার হলেন গোদাগাড়ী উপজেলার লালবাগ হেলিপ্যাড গ্রামের মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে মাহবুব আলম। মেসার্স বন্ধু বীজ ভান্ডারের বাজার জাতকৃত ইউএস-নসিব জাতের টমোটর বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছে উপজেলার হাজার হাজার কৃষক। বীজ বপন করা হতে শুরু করে গাছের ফুল ও ফল আসা পর্যন্ত এই বীজের কার্যকারিতা ভাল না থাকায় হাজারো কৃষক এখন হতাশায় ভূগছেন। তাদের চিন্তা গাছ বড় না হওয়া, ফুল ও ফল এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত না দেখা দেওয়ায় টমেটোর ভাল ফলন আশা করা যায় না। তাই তাদের কষ্ট অর্জিত শ্রম বৃথা যাবে সেই সাথে অর্থনৈতিক ভাবে ধ্বংস হবে। ঋণ কৃত টাকা পরিশোধের জন্য পথে বসতে হবে তাদের। উপজেলা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ইউএস-নসিব জাতের টমেটো বীজ লাগিয়ে গত দুই বছর ফলন ভালই হয়েছে। এবারও সেই ভালোর আশায় নসিব জাতের বীজ কিনে টমেটো লাগিয়ে বিপদে পড়েছি।

গোদাগাড়ী পৌর এলাকার লালবাগ হেলিপ্যাড গ্রামের আমির আলীর ছেলে টেমেটো চাষী আব্দুর রশিদ (৪৫) জানান, আমি এবার ১ বিঘা জমিতে বন্ধু বীজ ভান্ডারের মলিক মাহবুব আলমের নিকট হতে হাইব্রিড জাতের ইউএস-নসিব জাতের বীজ ১০ গ্রাম ৮৫০ টাকা দিয়ে কিনে জমি লাগিয়েছি কিন্তু এখন পর্যন্ত ফুল ও ফলের তেমন ভাল ফলাফল দেখতে পাচ্ছি না। গাছে খুব ফুল দেখা যায়নি তবে যেসব গাছে ফুল ও ফল এসেছে টমোটোর গুটি বাঁধা অবস্থায় আছে। আজ বিশ দিন হতে ফল বড় হয়নি একই অবস্থা আছে। ছোট গুটি বাঁধা টমেটো খুব শক্ত আর বড় হবে না বলে মনে হচ্ছে।

এছাড়াও টমেটো গাছ রুগ্ন অবস্থায় আছে। তিনি এক বিঘা জমিতে লেবার খবর সহ সবমিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ করেছেন কিন্তু এই টাকা উঠাবে না বলে জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ১০ গ্রাম বীজে ১ বিঘা জমিতে টমেটো লাগানো যাই কিন্তু বীজ ভালো ভাবে না গজানোর কারনে মাত্র ৫ কাটা জমি লাগাতেই হিমশিম খেতে হয়েছে।

গোদাগাড়ী ইউনিয়নের লোহাবড়িয়া গ্রামের মৃত ফাইজুদ্দীনের ছেলে কৃষক আশরাফুল হক (৫৫) বলেন, দেড় বিঘা জমিতে হাইব্রিড ইউএস-নসিব জাতের বীজ দিয়ে টমেটো লাগিয়েছে কিন্ত আবারও সেই সিনজেনটা কোম্পানীর সবল এফ-১ বীজের মতো ঘেরা খেয়েছি।

নসিব জাতের বীজ গত বছর গুলোতে ভাল ফলাফল ও টমেটো চাষ করে লাভ হওয়ার পর কৃষকদের একটি আস্থা অর্জন করেছিলো কিন্তু এই কোম্পানীয় সবলের মতই প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, হাইব্রিড ইউএস-নসিব বীজ দেবার নাম করে প্যাকেটে অন্যবীজ ঢুকিয়ে দিয়ে কৃষকদের কাছে বিক্রি করেছে। এটা আসল নসিব জাতের বীজ নয়। নসিবের গাছে ফল আসলে সবুজ রং এর হতো এটা শুরু হতেই সাদা ফ্যাকশে রংগের দেখা দিয়েছে। ১৫-২০ হলো গাছে গুটি বাঁধলেও তা বড় হচ্ছে না একই রকম অবস্থায় আছে। গাছ রুগ্ন ও কোঁকড়ানো অবস্থায় আছে গাছের ডালপালা ছড়িয়ে পড়ছে না।


সব মিলিয়ে কৃষক আশরাফুল ইসলাম চিন্তিত আছেন যে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ করে দেড় বিঘা জমি লাগিয়ে টাকা উঠাতে পারবেন কি না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বারবার কৃষকদের প্রতারিত করে বীজ কোম্পানী গুলো প্রতারিত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর কত কৃষকদের রক্ষ চুষে খাবে, সরকারই বা কি করছে। কথা বলার সময় তার চোখে মুখে ফুটে উঠে ছিলো হতাশা আর দুশ্চিন্তা। তিনি আরও বলেন, আমরা এই সময়টা একটু আশাবাদী টমেটো চাষ করে টাকা ঘরে তুলে দুবেলা ছেলে মেয়ে নিয়ে ভাল খাবার কিন্তু আর হলো না। অন্যান্য বছর তিনি সমপরিমান টমেটো আবাদ করে এক হতে দেড় লাখ টাকা মতো আয় করেন বলে জানান।

ভাসপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে টমেটো চাষী রুবেল (৩০), একই গ্রামের সেরাজুল ও খালেদা বেগমের সাথে কথা হলে তারা জানান, নদী ভাঙ্গনের কারনে ভিটে মাটি হারিয়ে চর এলাকা হতে এসে এসব এলাকায় কোন রকম মাথা গোজার ঠাঁই নিয়েছি।  অন্যের জমি বর্গা নিয়ে দেড়-দুই বিঘা জমি নিয়ে টমেটো চাষ করেছি কিন্তু ইউএস-নসিব জাতের নিন্মমানের বীজের কারনে আবারও আমাদের পথে বসতে হবে।

আমতালা এলাকার বন্ধু বীজ ভান্ডারের ডিলার মুকুলের নিকট হতে বীজ নিয়ে টমেটো লাগালে বীজ বপন হতে শুরু করে ফল আসা পর্যন্ত ফলাফল খুব খারাপ টমেটো গুটি বাঁধা হতেই শেষ । আর ফল বড় হবে না সেই সাথে আমাদের টাকাও উঠে আসার সম্ভাবনা নেই বলে জানান। সেরাজুল ও খালেদা বেগম বলেন কীটনাশকের দোকান গুলোতে সব টাকা বাকি রেখে আবাদ করেছি এখন সেই টাকা কি ভাবে পরিশোধ করবো এই চিন্তাই আছি। যাদের কাছে টাকা পয়সা ধারদেনা করে আবাদ করেছি তারা তো ছাড়বে না সময় হলেই টাকা জন্য পাড়াপড়ি করবে। প্রয়োজনে ঘরের টিন বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করতে হবে। এরই মাঝে কেউ কেউ বলে উঠেন টাকা না উঠলে বীজ ডিলার ও বীজ বাজারজাত করন কোম্পানীর পরিচালক বন্ধু বীজ ভান্ডারের মালিক মাহবুব কে ঘিরে টাকা আদায় করে ছাড়বো। কৃষকদের সাথে এমন প্রতারণা সহ্য করা হবে না।

তারা বলেন শুনেছি মাহবুব আলম নাকি এই বীজ বিক্রয় করে কোটি টাকা ব্যায়ে আলিশান বাড়ী তৈরী করছে। অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন এসব কৃষকদের সাথে প্রতারনা করে কোটি পতি হয়েছেন। এমনি অভিযোগ উপজেলার হাজারো কৃষক। যে কোন সময় কৃষক রাগে ক্ষোভে বন্ধুবীজ ভান্ডার কোম্পানীর মালিক মাহবুব আলমের বাড়ী ঘেরাও করতে পারে আসতে পারে কৃষকদের পক্ষ হতে বৃহত্তর আন্দোলন। রবি মৌসুমে গোদাগাড়ী উপজেলায় শুধু মাত্র লালস্বর্ণ হিসেবে খ্যাত টমেটো হতে প্রায় ৩ হতে ৪ কোটি টাকা অর্থনীতি অর্জনে ভূমিকা রাখে কিন্ত কালে কালে এসব বীজ কোম্পানী হতে প্রতারিত হবার কারনে কৃষকরা টমেটো চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।


জানা গেছে বন্ধু বীজ ভান্ডারের পরিচালক মোঃ মাহবুব আলম কৃষকদের সাথে বীজ প্রতারণা করে এলাকা ছেড়েছে। তার লালবাগ হেলিপ্যাডের বাড়ী হতে বৌ- বাচ্চ নিয়ে গোগ্রামের ইউনিয়নের লালপুকুড়ীয়া এলাকায় প্রায় ১৪ বিঘার উপর নির্মিত আলিশান বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন। কৃষকদের হাতে লাঞ্চিত আর অপমান অপদস্থ হবার কারনে এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। আর উপজেলা সদরে বন্ধু বীজ ভান্ডার দোকানটি কর্মচারী দিয়ে একবেলা খুলছেন কিন্তু কৃষকদের চাপে সেই কর্মচারী ঠিকমত খুলতে গড়ি মসি করছে। কোন রকম স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন মাহবুব ইসলাম বীজ ব্যবসায় বেশ সুনাম অর্জন করলেও কৃষকদের সাথে এই প্রতারণা এলাকার লোকজন এখন খারাপ চোখে দেখছে। বিগত বছর গুলোতে তার কোম্পানীর বীজ গুলো আমেরিকা হতে আমদানিকৃত বলে কৃষকদের কাছে প্রচার চালায়। কিন্ত এবার সেই বীজের ফলাফল ভাল না হওয়ার কারনে তার বদমান ও প্রতারণার ফাঁদ বুঝতে পেরে কৃষক সমাজ ফুসে উঠছে।

বন্ধু বীজ ভান্ডারের পরিচালক ও ইউএস-নসিব বীজ বাজারজাতকারি মোঃ মাহবুব আলমের সাথে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল ও ম্যাসেজ পাঠিয়ে কোন সাড়া পাওয়া যায় নি। রোববার তার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেটিও বন্ধ দেখা যায়। তবে তার দোকানের কর্মচারী আসাদুজ্জামান জানান, তিনি কোথায় আছেন আমি বলতে পারব না। দুইদিন হতে আমিও তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।

হাইব্রিড ইউএস-নসিব বীজের প্যাকেটিতে কোন দেশ হতে আমদানিকৃত তা লেখা নেই। প্যাকেটে ব্যবহৃত লেখা গুলোও অস্পস্ট ও স্টিকার গুলো সন্দেহ জনক। দেখে মনে হবে নিজেরাই বীজ প্যাকেট করে বাজারজাত করেছে। গোদাগাড়ী উপজেলায় এবার ২৬৩০ হেক্টর জমিতে টমেটো আবাদ হয়েছে তবে অধিকাংশই নসিব জাতের টমেটো চাষ করে কৃষকরা।

গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব মোঃ তৌফিকুর ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ইউএস নসিব টমেটো বীজ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন কৃষক অভিযোগ করেনি অভিযোগ করলে আমরা তা তদন্ত করে দেখবে তবে তিনি বীজ নিয়ে সমস্যা হয়ে তা আমি শুনেছি।

ইউএস-নসিব টমেটো বীজ বাজারে কি পরিমান বিক্রয় ও আমদানি করেছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ তৌফিকুর রহমান ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মরিয়ম আহমেদ বলেন এগুলো হাইব্রীড বীজ এসব তথ্য চাওয়া হয় কেউ দেয় আবার কেউ ঠিকমত দেয় না বলে জানান।

কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা মরিয়ম বলেন আমরা বিষয়টি নিয়ে বেশ ভালভাবে খোঁজ খবর রাখছি বীজ প্রতারণার সত্যতা পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান।

২০১০ সালের দিকে সিনজেনটা কোম্পানীর হাইব্রিড টমেটো সবল-এফ ১ বীজ কৃষকদের মাঝে অত্যান্ত নিন্ম মানের বীজ বিক্রয় করে হাজারো কৃষককে পথে বসতে হয়েছিলো । অর্থনৈতিক ভাবে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো । সেই সময়ে সবল এফ-১ বীজের প্রতি কৃষকদের আস্থা অর্জন করায় সেই টমেটো লাগাতে কৃষকরা এগিয়ে আসে। কিন্তু কৃষকদের সরল বিশ্বাসে প্রতারনা করে কোম্পানী। ২০১০ সালের ২৩ নভেম্বর গোদাগাড়ী কৃষি উন্নয়ন ঐক্য পরিষদ নামে বীজ প্রতারনা ও ক্ষতি পূরনের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রধানমন্তী বরাবর স্মারকলিপি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারফত পাঠানো হয়। তার অনুলিপি কৃষি মন্ত্রী, আইন মন্ত্রী, স্বারষ্ট্র মন্ত্রী, কৃষি সচিব, কৃষি অধিদপ্তর মহাপরিচালক বরাবর পাঠনো হয়। পরে গোদাগাড়ী কৃষি উন্নয়ন ঐক্য পরিষদের আহবায়খ মুখলেসুর রহমান আদালতে মামলা করে কোন ফল পাওয়া যায় নি এখন পর্যন্ত।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী সিনজেনটা কোম্পানীর বীজ প্রতারনা নিয়ে কৃষকদের ক্ষতি পূরনের দাবির সাথে একাত্বতা জানিয়ে তিনি ২০১১ সালে ৮ ডিসেম্বর সংসদ অধিবেশন চলাকালীন পয়েন্ট অব অর্ডারে দাড়িয়ে বীজ প্রতারণা ও কৃষকদের ক্ষতি পূরন ও কোম্পানীর বিচার দাবি করে কৃষি মন্ত্রীর নিকট দৃষ্টি আকর্ষন করেন।

কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বললেও আজ পর্যন্ত এর কোন ফলাফল পাওয়া যাই নি। কৃষকদের এখন দাবি বার বার কৃষকদের সাথে বীজ প্রতারনা করলে কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। এসব প্রতারক ব্যবসায়ীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন কৃষক মহল। নইলে বৃহত্তর আন্দোলন করারও হুশিয়ারী দেন তারা।
স/শ