আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ট্রেডিং সুবিধা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশনে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে, যার কারণে এখন দেশের ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে ট্রেডিং ব্যবসা করার সুযোগ পাবেন। বিগত দুই দশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধরনে যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে এই ধরনের সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। অনেক দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, এ জন্য তাদের সাধুবাদ।

বিগত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত করেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

তৈরি পোশাক এবং ওষুধ রপ্তানি ছাড়াও দেশে অনেক নামকরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যাদের সুখ্যাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রসারিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। এ ছাড়া অনেক অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানির সুযোগ অবারিত হয়েছে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নীতিমালা (ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন) সেভাবে আধুনিকায়ন করা হয়নি। ফলে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের অনেক ব্যবসায়ী রপ্তানি বৃদ্ধি বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছেন না। আমাদের দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এখনো এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) নির্ভর। অর্থাৎ সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এলসি ব্যতিরেকে আমাদের দেশে এখনো ব্যাপকহারে আমদানি-রপ্তানির কথা কল্পনাও করা যায় না। অথচ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এলসির ব্যবহার প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। উন্নত বিশ্বে তো এখন আর সেভাবে এলসির প্রচলন নেই বললেই চলে। উন্নয়নশীল দেশে এখনো এলসির ব্যবহার কিছুটা চালু আছে। খুব সহসাই এখানেও এই এলসির প্রচলন হ্রাস পাবে এবং এক পর্যায়ে বন্ধও হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা নীতিতে যথাযথ পরিবর্তন আনতে না পারার কারণে ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতা বা বৈরী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক খুব সঠিক কাজটি করেছে এবং এর মাধ্যমে আমাদের দেশের সেকেলে বৈদেশিক মুদ্রা নীতিমালা হালনাগাদ বা আধুনিক করার কাজে হাত দিয়েছে বলেই আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক বাজারে ট্রেডিং করার সুযোগ করে দিয়ে মার্চেন্টিং ট্রেড নামে এক নীতিমালা জারি করেছে। এই নীতিমালার মাধ্যমে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সরাসরি ট্রেডিং করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং এটি সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন করতে হলে বিস্তারিত নীতিমালা এবং সঠিক দিকনির্দেশনার প্রয়োজন আছে। আমি অনেক চেষ্টা করেও মার্চেন্টিং ট্রেড নীতিমালা পাঠ করার সুযোগ পাইনি। পক্ষান্তরে এত বড় একটি সিদ্ধান্তের কথা মিডিয়ায়ও সেভাবে আসেনি। ফলে এই নীতিমালাটি কিভাবে কাজ করবে এবং কোন কোন ব্যবসায়ী কী ধরনের ট্রেডিং করতে পারবেন তা আমরা পরিষ্কার জানতে পারিনি।

যাই হোক, সেই নীতিমালায় সব কিছু বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে বলেই আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে নিশ্চয়ই কাঁচা কাজ করবে না। তবে ঘোষিত নীতিমালায় যা-ই থাকুক না কেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ট্রেডিং শুরুর কাজটা ছিল খুবই জরুরি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক অন্তত সেই শুরুটা করতে পেরেছে। যদি কোনো সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন হয় সেটি সময়ের আবর্তে ঠিক করে নেওয়া যাবে।

বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিশেষ করে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এমন এক সময় ছিল যখন বিদেশের আমদানিকারকরা আগে থেকে এলসি পাঠিয়ে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতেন এবং উৎপাদনকারীরাও নিশ্চিত এলসি পেয়েই পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করতেন। এখন তো সেই অবস্থা আর নেই, বরং সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থা বিরাজ করছে। এখন আমদানিকারকরা কোনো এলসি দেন না। ফলে রপ্তানিকারকরা এলসি ছাড়া পণ্য পাঠিয়েই যে ক্ষান্ত হন তেমন নয়, অনেক ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক আমদানিকারকের স্টোরে নিজ দায়িত্বে পণ্য পৌঁছে দেন, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাজিয়েও দিয়ে থাকেন। একইভাবে এমন এক সময় ছিল যখন উন্নত বিশ্বের বৃহৎ ব্যবসায়ীরা দেখেশুনে উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সরাসরি দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় বা আমদানি করতেন। এখন আর সেই অবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেই। এখন উন্নত বিশ্বের রিটেইল ব্যবসায়ীরা উৎপাদনকারীদের কাছে থেকে পণ্যসামগ্রী সংগ্রহের ঝুঁকিটা কৌশলে অন্যের কাঁধে দিয়ে দিয়েছেন। আর এই ঝুঁকিটা নিয়ে নিয়েছেন মধ্যস্বত্বভোগী ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা। এ কারণেই দেখা যায় উন্নত বিশ্বে অনেক ট্রেডিং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সহযোগী বা সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান খুলে বিশ্বব্যাপী রমরমা ট্রেডিং ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থার এমন পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদেরও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সরাসরি ট্রেডিং করার সুযোগ থাকতে হবে এবং সাম্প্রতিক সময়ে মার্চেন্টিং ট্রেড নীতিমালার আওতায় আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ পাবেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রেডিং করার অনুমতি দিলেই তো আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ট্রেডিং শুরু করে দিতে পারবেন না। ব্যবসায়ীরা কিভাবে এই ট্রেডিং করবেন তার একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজন প্রথম দিকে ব্যবসায়ীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে তাঁরা কাজটি সফলভাবে শুরু করতে পারেন। যেমন—বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ী নেপাল থেকে পণ্যসামগ্রী সরাসরি ফ্রান্সে রপ্তানি করতে পারবেন এবং সে ক্ষেত্রে এলসি ব্যাংক হবে বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক এবং অর্থ প্রাপ্তির পর নেপালের ব্যবসায়ীর অর্থ পরিশোধ করা হবে। এ ধরনের উদ্যোগ সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কেননা নেপালের ব্যবসায়ী মুখের কথায় কোনো  অর্থ পরিশোধের নিশ্চয়তা ছাড়া পণ্যসামগ্রী ফ্রান্সে পাঠিয়ে দেবেন তেমনটা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নেপালের ব্যবসায়ীর সঙ্গে অংশীদারি প্রতিষ্ঠা করতে হবে অথবা নেপালে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর কোনো সহযোগী বা সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। এই দুটি কাজের জন্য দেশ থেকে অর্থ নিয়ে নেপালে বিনিয়োগ করতে হবে এবং সে কারণেই এই বিনিয়োগের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। সরাসরি বিনিয়োগ ব্যতিরেকে স্ট্যান্ডবাই এলসির মাধ্যমে এই ধরনের ট্রেডিং বাণিজ্য পরিচালনা করা হয়ে থাকে। অথচ আমাদের দেশে স্ট্যান্ডবাই এলসির প্রচলন সেভাবে শুরুই হয়নি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আগে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দিয়ে এই স্ট্যান্ডবাই এলসি জনপ্রিয় করে তুলতে হবে এবং তখনই হয়তো এই মার্চেন্টিং ট্রেড নীতিমালার অধীনে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ট্রেডিং সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে মোটেই পরিষ্কার নয়। তা হচ্ছে, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা কি শুধু দেশের অভ্যন্তরে থেকেই সরাসরি এই ট্রেডিং করার সুবিধা পাবেন, নাকি দেশের বাইরে সুবিধাজনক স্থানে অফিস খুলে বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে সেখান থেকেও সরাসরি ট্রেডিং করার সুযোগ পাবেন। যদি শুধু দেশের অভ্যন্তরে থেকে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ট্রেডিং করার সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে এই উদ্যোগ থেকে উল্লেখযোগ্য সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই বললেই চলে। এই উদ্যোগ থেকে শতভাগ সফলতা পেতে হলে আমাদের ব্যবসায়ীদের বিশ্বের সুবিধাজনক স্থানে অফিস বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে সেখান থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ট্রেডিং করার সুযোগ করে দিতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যাঁরা সরাসরি ট্রেডিং করছেন তাঁরা এভাবেই বিশ্বের সুবিধাজনক স্থানে অফিস বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেই সেটা করছেন। আমেরিকার অনেক নামিদামি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হংকং, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাদের অফিস বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান খুলে এই ট্রেডিং ব্যবসা পরিচালনা করছে। জাপানের একটি নামকরা গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ আমেরিকার মেক্সিকো এবং কলম্বোতে তাদের সাবসিডিয়ারি কম্পানি প্রতিষ্ঠা করে এই ট্রেডিং ব্যবসা পরিচালনা করছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশের অনেক কম্পানি লাতিন আমেরিকার চিলি, পেরু এবং উরুগুয়েতে তাদের অফিস বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে এই ট্রেডিং ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এ কারণেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ট্রেডিং ব্যবসার যে ধরন তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের ব্যবসায়ীদেরও সমান সুযোগ করে দিতে হবে। তা না হলে সরাসরি ট্রেডিং সুবিধা দিলেও খুব একটা লাভ হবে না।

সরাসরি ট্রেডিং সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থপাচারসহ বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার বিষয় সামনে চলে আসা খুবই স্বাভাবিক। এ কারণেই ঢালাওভাবে সব ব্যবসায়ীকে এই সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না। যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং যাদের দীর্ঘদিনের সুখ্যাতি আছে, শুধু তারাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সরাসরি ট্রেডিং করার সুযোগ পাবে। তা ছাড়া অর্থপাচারের মতো জুজুর ভয়ে তো আর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের আধুনিকায়ন বন্ধ রাখা যাবে না। যত কঠোর নিয়মনীতিই গ্রহণ করা হোক না কেন, যারা অর্থ পাচার করে তারা সব সময়ই সেটা করে থাকে। এত দিন যে সরাসরি ট্রেডিং করার সুযোগ ছিল না, তাতে কি অর্থপাচারের অভিযোগের কোনো কমতি ছিল? যাঁরা সৎ এবং নিবেদিতপ্রাণ ব্যবসায়ী, তাঁরা কখনো বিদেশে অর্থ পাচার করেন না। তার পরও যদি অর্থপাচারের ঝুঁকি বড় হয়ে দেখা দেয়, তাহলে সেই ঝুঁকি লাঘবের উপায়ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেই আছে। বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট বিধায় এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই।

মোটকথা, বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগটি যথার্থই নিয়েছে। এখন এই উদ্যোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা যাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীদের মতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সরাসরি ট্রেডিং সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি তথা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন, সে জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা-ই করতে হবে।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

Nironjankumar_roy@yahoo.com

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ