আটকে পড়াদের নিয়ে দর-কষাকষি

ইউক্রেনে অব্যাহত যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের মধ্যে রাশিয়া বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে নিতে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা দিয়েছে, যা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। আটকে পড়া মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার পর পর দুটি উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর গতকাল সোমবার নতুন এই প্রস্তাব দেয় রাশিয়া। রুশ প্রস্তাবে বিপন্ন শহরবাসীদের ‘মানবিক করিডরের’ মধ্য দিয়ে অন্যান্য ইউক্রেনীয় শহরের পাশাপাশি খোদ রাশিয়া ও তার মিত্র বেলারুশের ভূখণ্ডে যাওয়ার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। ইউক্রেন এই প্রস্তাবকে নৈতিকতাহীন এবং তাদের পশ্চিমা মিত্র যুক্তরাজ্য ‘অবিশ্বাস্য রকম হীনম্মন্যতাপূর্ণ’ আখ্যা দিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতেই দুই পক্ষের আলোচকরা বেলারুশে তৃতীয় দফা আলোচনায় বসেন।

আলোচনায় বসার আগে ইউক্রেনের প্রধান প্রতিনিধি মিখাইলো পোদোলিয়াক বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। এরপর গত রাতে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ইউক্রেন তিনটি শর্ত মেনে নিলে যেকোনো মুহূর্তে হামলা বন্ধ করবে মস্কো।

এদিকে রুশ সেনাদের বেসামরিক লোকদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, এ জন্য তাদের একদিন বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।

রাশিয়ার বিতর্কিত প্রস্তাব : মস্কোর প্রস্তাবের অধীনে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে পলায়নপর বেসামরিক নাগরিকদের রাশিয়ার মিত্র বেলারুশে যাওয়ার করিডর দেওয়া হবে। অন্যদিকে খারকিভের বাসিন্দাদের জন্য একটি করিডর থাকবে, যা শুধু রাশিয়ার দিকে যাবে। রুশ সেনাদের ঘেরাও করা শহর মারিওপোল ও সুমি থেকে বের হওয়ার পথগুলো দিয়ে অন্যান্য ইউক্রেনীয় শহর এবং রাশিয়ার শহরে যাওয়া যাবে।

ইউক্রেন অভিযোগ করে বলেছে, রাশিয়ার সেনারা হাসপাতাল ও স্কুলগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে এবং বেসামরিক নাগরিকরা হামলার শিকার হচ্ছে। তবে রাশিয়া বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছে যে তারা ইউক্রেনের ‘জাতীয়তাবাদী’ ও ‘নব্য নাৎসিদের’ বিরুদ্ধে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চালাচ্ছে।

তৃতীয় দফা আলোচনা শুরু : রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তৃতীয় দফা আলোচনা শুরু হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে ইউক্রেনের প্রধান আলোচক একটি টুইটে বলেন, ‘কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা এমন একটি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করব, যারা সত্যিই বিশ্বাস করে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সহিংসতা একটি যুক্তিতর্কের বিষয়। প্রমাণ করুন যে আসলে বিষয়টি তা নয়। ’

ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের তথ্য মতে কিয়েভ সময় বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশে রাত ৪টা) আলোচনা শুরু হয়।

এ ছাড়া রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বৃহস্পতিবার তুরস্কের আন্টালিয়ায় ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার তিন শর্ত : ‘যেকোনো মুহূর্তে’ যুদ্ধ বন্ধের শর্ত হিসেবে ক্রেমলিনের মুখপাত্র বলেছেন, প্রথমত, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, লুহানস্ক ও দোনেত্স্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে হবে। তৃতীয়ত, ইউক্রেনকে অবশ্যই তার সংবিধানে পরিবর্তন এনে কোনো ধরনের জোটে যোগ দেওয়ার অভিপ্রায় ত্যাগ করতে হবে।

যুদ্ধের অবস্থা : রাজধানী কিয়েভের উপকণ্ঠে অবস্থিত ইরপিনে ক্রমাগত রাশিয়ার গোলাবর্ষণ চলে। তবে কর্তৃপক্ষ বলেছে দুই হাজার লোক একটি অস্থায়ী সেতুর মাধ্যমে শহর ছেড়ে চলে যেতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর কাছাকাছি জনপদ হোস্টোমেলের গ্রাম পরিষদ বলেছে, সেখানকার মেয়র রুটি ও ওষুধ বিতরণ করার সময় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দক্ষিণে মাইকোলাইভ শহরও আক্রমণের মুখে পড়ে। ইউক্রেন বলেছে, কামানের গোলা আগের রাতে শহরের আবাসিক এলাকায় আঘাত করে। মাইকোলাইভ শহরটি ক্রিমিয়া এবং দক্ষিণের বন্দর শহর ওডেসার মধ্যে অবস্থিত।

বন্দরনগরী মারিওপোলে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ বিদ্যুৎ, খাদ্য ও পানির সংকটের মধ্যে রয়েছে। পালিয়ে আসা একটি পরিবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছে, তারা ‘সর্বত্র লাশ’ দেখেছে।

কূটনৈতিক তৎপরতা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গতকাল রাতে ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে ফোনালাপ করার কথা ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন লন্ডনে রাশিয়ার ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার বিষয়ে কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেন।

বরিস জনসন জোর দিয়ে বলেন, তাঁর সরকার ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের প্রতি ‘খুব উদার’ হবে। কিন্তু তাদের কোনো রকম যাচাই ছাড়া নির্বিচারে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। গত রাতে কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জনসন ইউক্রেনের সরকারকে সহায়তার জন্য আরো ১৭ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড সহায়তার ঘোষণা দেন। এ নিয়ে ব্রিটিশ সহায়তা ৪০ কোটি পাউন্ডে উঠল। সংবাদ সম্মেলনে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ইউক্রেনে ‘অন্যায্য আগ্রাসনের সহযোগী’ আখ্যা দিয়ে রাশিয়ার ১০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন।

সংলাপের অনুরোধ মোদির : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে অনুরোধ করেছেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন মোদিকে ইউক্রেনীয় ও রুশ আলোচকদলের মধ্যে সংলাপের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেন।

চীন মুখ খুলল : রাশিয়ার মিত্র চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইউক্রেনকে মানবিক সহায়তা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। ওয়াং ই কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব ‘প্রস্তরকঠিন’ এবং তাদের মধ্যে সহযোগিতার সম্ভাবনা অনেক বিস্তৃত।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন রাশিয়ার নিন্দা করার জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানানোর কয়েক ঘণ্টা পর চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাগুলো আসে।

জেলেনস্কির আহ্বান : জেলেনস্কি তাঁর ব্রিফিংয়ে গতকাল বলেছেন, রাশিয়ার অব্যাহত হামলা প্রমাণ করে যে দেশটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তার পরিকল্পনা ত্যাগ করেনি। তিনি যোগ করেন, ‘আমাদের একটি নতুন নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ দরকার। ’

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ