আজ ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, বাংলাদেশ কি চাইছে

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

আজ সোমবার (২২ এপ্রিল) দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকা আসছেন কাতারের বর্তমান আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। এর মাধ্যমে প্রায় দুই দশক পর দেশটির কোনও আমির বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখতে যাচ্ছেন।

এছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এটিই মধ্যপ্রাচ্যের কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম বাংলাদেশ সফর।

সব মিলিয়ে কাতারের আমিরের এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু এই সফর থেকে বাংলাদেশ ঠিক কী অর্জন করার প্রত্যাশা করছে?

রোববার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের দেশে এনার্জির মজুদ আরও বাড়ানোর ক্ষেত্রে এবং এনার্জি সিকিওরিটি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমি মনে করি এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।‘

কাতার মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি শ্রমবাজার। জ্বালানি আমদানি, বিশেষ করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কাতারের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল।

তাছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও কাতার দিন দিন ‘গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়’ হয়ে উঠছে। ফলে বাংলাদেশ তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়াতে চাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

‘শ্রমবাজার, জ্বালানি নির্ভরতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বর্তমানে কাতারের যে অবস্থান, সব মিলিয়ে দেশটির আমিরের এই সফর নি:সন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ’ বলছেন বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির।

এগারোটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক
এর আগে ২০০৫ সালে কাতারের তখনকার আমির হামাদ বিন খলিফা আল থানি শেষবার রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। প্রায় দুই দশক পর বর্তমান আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকা আসছেন।

সোমবার বিকেলে একটি বিশেষ ফ্লাইটে কাতারের আমির ঢাকা পৌঁছাবেন বলে জানা গেছে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।

এই সফর চলাকালে দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অন্তত ১১টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এর মধ্যে ছয়টি চুক্তি এবং পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে বলে জানান তিনি।

চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে: দ্বৈতকর পরিহার, আইনগত বিষয়ে সহযোগিতা, সাগরপথে পরিবহন, বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা, দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হস্তান্তর এবং যৌথ ব্যবসা পরিষদ গঠন সংক্রান্ত চুক্তি।

অন্য দিকে, শ্রমশক্তি, বন্দর পরিচালনা, উচ্চ শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যুব ও ক্রীড়া সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ সহযোগিতার উপর সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে জানা গেছে।

“বাংলাদেশের সাথে কাতারের বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, বন্ধুত্বপূর্ণ ও বহুমুখী। আমরা আশা করছি, এই সফরের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে যে অত্যন্ত চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সেটি আরও উচ্চতায় উন্নীত হবে।”বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

কাতারের আমিরের নামে ঢাকায় একটি সড়ক ও পার্কেরও নামকরণ করা হচ্ছে।

দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক এবং আমিরের সফরকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে এই নামকরণ করা হচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

ঢাকার মিরপুরের কালসি বালুর মাঠ এলাকায় নির্মিতব্য ওই পার্ক এবং মিরপুর ইসিবি চত্বর থেকে কালসি উড়াল সেতু পর্যন্ত সড়কটি কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি নিজেই উদ্বোধন করবেন বলে জানানো হয়েছে।

অগ্রাধিকারে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য
কাতারের আমিরের সফরকে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য বড় সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে সরকার। কাজেই বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কাতারকে আগ্রহী করে তোলার বিষয়টি এবারের সফরে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

ইতিমধ্যেই কাতারের বন্দর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান মাওয়ানি বাংলাদেশে বন্দর ব্যবস্থাপনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটি মহেশখালীর মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন বন্দরের ব্যবস্থাপনা করতে চায়।

যদিও বাংলাদেশ এখনই প্রতিষ্ঠানটিকে এ বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া বিষয়ে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে মাওয়ানি কাতারকে যুক্ত রাখার প্রেক্ষাপটে এ সফরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে জানা গেছে। কারণ বন্দর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কাতারের বিশ্বব্যাপী সুনাম আছে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিনিয়োগে আগ্রহ সৃষ্টি করতে কাতারকে আলাদা ইকোনোমিক জোন দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হবে বলেও জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। পাশাপাশি কাতারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও জোর দিচ্ছে সরকার।

জ্বালানি নিরাপত্তা
কাতার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানির জন্য ২০১৭ সালে ১৫ বছরের জন্য একটি চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী, এখন প্রতি বছর প্রায় ৪০ কনটেইনার (১.৮-২.৫ এমটিএ) জ্বালানি আমদানি করছে সরকার, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন-সহ নানান কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখন বাংলাদেশ আরও অধিক এলএনজি সরবরাহ চায়। সেই লক্ষ্যে গত বছর কাতারের সাথে দীর্ঘমেয়াদী একটি চুক্তিও করে সরকার। সেই চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি বছর কাতার থেকে অতিরিক্ত এক দশমিক আট এমএমটি এলএনজি পাবে, যার সরবরাহ শুরু হবে ২০২৬ সাল থেকে।

কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে শুরু করেছে। ফলে ২০২৬ সালের আগেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো যায় কি না, সে বিষয়ে কাতারের আমিরের সাথে আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে।

এদিকে, গ্যাসের আমদানির পাশাপাশি বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কাতারের বিনিয়োগ আনার প্রতি গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দিচ্ছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি।

দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি
সরকারি হিসেবে কাতারে বর্তমানে চার লক্ষেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই গেছেন অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে। ফলে অন্যান্য দেশের দক্ষ শ্রমিকদের তুলনায় তারা সেখানে কম বেতন ও অন্যান্য সুবিধাও কম পেয়ে থাকেন।

পাশ্বর্বতী দেশ ভারত-পাকিস্তান থেকে কাতার দক্ষ শ্রমিক নিলেও বাংলাদেশ থেকে স্বল্প দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক যাচ্ছে। ফলে বেশি কাজ করেও তারা সে অনুযায়ী রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে না।

তবে বর্তমানে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত দক্ষ শ্রমিক রয়েছে। এবারের সফরে অবশ্যই এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

“আমরা আরও বেশি দক্ষ শ্রমিক কীভাবে কাতারে পাঠাতে পারি, সেটি নিয়ে আমিরের সাথে আলোচনা করা হবে”, সাংবাদিকদের বলেন হাছান মাহমুদ।

বন্দী বিনিময়
শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক কাতারের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী রয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আলোচনা চলছে বলে এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।

“এটি এখন আর কেবল আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। চুক্তিই স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে”, রোববার সাংবাদিকদের বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

এই চুক্তির ফলে দুই দেশ সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের হস্তান্তর করতে পারবে। ফলে কাতারের কারাগারে বন্দী বাংলাদেশি নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছে সরকার। এর আগে ভারত ও থাইল্যান্ডের সঙ্গেও বন্দী বিনিময় চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
২০২৩ সালের মার্চে কাতারের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছিল বাংলাদেশ। যদিও সেটি এখনও কার্যকর হয়নি বলে জানা গেছে। তবে কাতারের আমিরের ঢাকা সফরে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়টি আলোচনায় থাকতে পারে।

এ মুহূর্তে কাতারের নৌবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের একটি সমঝোতা স্মারক রয়েছে। এর আওতায় কোস্টগার্ডের সদস্যরা কাতারে কাজ করছেন।

আর গত বছর স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকটি কার্যকর হলে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও কাতারে কাজ করার সুযোগ পাবে বলে জানা গেছে।

উচ্চশিক্ষা
কাতারে বাংলাদেশিদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের সুযোগ তৈরি করার জন্য সে দেশের আমিরের এবারের সফরে একটি সমঝোতা স্মারক সই করতে যাচ্ছে সরকার। এর ফলে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার নতুন দ্বার উন্মুক্ত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দেশটির আমিরের সাথে আলোচনা করে সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে এদেশের শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সংখ্যায় বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও গবেষণা করার সুযোগ পাবেন বলেন মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়া ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ নিয়েও এই সফরে আলোচনা হতে পারে। কারণ কাতারের আমির এমন একটি সময়ে বাংলাদেশে আসছেন, যখনই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়েছে। আর কাতার সেই সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থকারীর ভূমিকা পালন করছে।

কাজেই এই সংঘাতের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান কাতারের সামনে তুলে ধরা হতে পারে বলে জানা গেছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা