আগামী নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী বিশ্বসম্প্রদায়, থাকবে নিবিড় দৃষ্টি

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গভীর আগ্রহ আছে বিশ্বসম্প্রদায়ের। কী ঘটছে আর নির্বাচনে কী হচ্ছে, তাতে সবার স্বার্থ আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) শুধু নির্বাচন নয়, পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়ার দিকে নিবিড় দৃষ্টি রাখবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি গতকাল সোমবার ঢাকার একটি হোটেলে কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাবের সদস্যদের সঙ্গে ‘ডিকাব টক অনুষ্ঠানে’ এসব কথা বলেন।

চার্লস হোয়াইটলি ১২ বছর আগে বাংলাদেশে ইইউ মিশনে রাজনৈতিক শাখায় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এবার এসেছেন ইইউ মিশনের ডেলিগেশনপ্রধান ও রাষ্ট্রদূত হিসেবে। অনুষ্ঠানে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের যেকোনো দেশের সঙ্গে ইইউয়ের সম্পর্কের মূল ভিত্তি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। ইইউ অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখার জন্য নিজস্ব কাঠামো আছে। মানবাধিকার দেখভাল করার জন্য যেকোনো দেশে নিজস্ব কাঠামো থাকা উচিত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভউ (ইউপিআর) বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমাদের প্রথম দৃষ্টি থাকবে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার দিকে। নির্বাচন কোনো ইভেন্ট (অনুষ্ঠান) নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া। এর মধ্যে প্রস্তুতি, আইনি কাঠামো, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চুক্তি ও অন্যান্য বিষয় আছে।’

রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমি মনে করি, আমরা এগুলোতে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নজর রাখব। এর কারণ এই নয় যে আমরা এখানে হস্তক্ষেপ করতে চাই। বাংলাদেশে কী ঘটে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশ আগ্রহী। বাংলাদেশ এই অঞ্চলের কৌশলগত অংশ, উন্নয়নশীল, অর্থনৈতিক শক্তির কেন্দ্র। নির্বাচনে কী হয়, তাতে প্রত্যেকের এখানে স্বার্থ আছে।”

চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকব। নির্বাচনের এখনো দুই বছর বাকি। আমি মনে করি, এরই মধ্যে এ নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি, শেষ কথা হলো, যেকোনো নির্বাচনে ভোটের পর সকালে লোকজন ঘুম থেকে উঠে ফলাফল দেখে বুঝতে চায়, তাদের দেওয়া ভোট গণনা করা হয়েছে।’

রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, ‘এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটি বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার চর্চা করার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। আমি বলব, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক আগ্রহ আছে। আমরা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করব।’

রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার

রোহিঙ্গা বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, ইইউ মিয়ানমারের ৪৩ ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইইউ মিয়ানমারে উন্নয়ন সহযোগিতা স্থগিত করেছে, অস্ত্র রপ্তানিও নিষিদ্ধ করেছে। তবে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বাণিজ্য সুবিধাও স্থগিত করেনি। কারণ এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে, নারী পোশাক কর্মীদের শাস্তি দেওয়া হবে।

মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে ইইউ কাজ করছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত হোয়াইটলি বলেন, মিয়ানমারের নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে রোহিঙ্গাদের ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। যতক্ষণ না তাদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নকারীদের বিচার না হয় এবং তারা নিরাপদ বোধ না করে, ততক্ষণ তারা ফিরে যেতে পারে না।

মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক অব্যাহত রাখার কারণ জানতে চাইলে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা বাণিজ্য বন্ধ করিনি। কারণ আমরা যদি বাণিজ্য বন্ধ করি তাহলে যে শূন্যতা তৈরি হবে, তাতে অন্যদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর অন্যদের মিয়ানমারে গণতন্ত্র, মানবাধিকারকে সমর্থনের কোনো আগ্রহ না-ও থাকতে পারে।’

ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, এখানে অনেক বড় শক্তি আছে, যাদের মিয়ানমারের ওপর প্রভাব আছে। তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, ওই আইনের বিভিন্ন ধারা ও চলমান কিছু বিচার নিয়ে ইইউ গত মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকে উদ্বেগ জানিয়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর ইইউয়ের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি প্লাস পাওয়া প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, জিএসপি প্লাস স্বয়ংক্রিয় কোনো প্রক্রিয়া নয়। বাংলাদেশকে এর জন্য আবেদন করতে হবে।

রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘ইইউ থেকে ইঙ্গিত আছে এবং আমরা নিশ্চিত করতে চাই, বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস যেন পায়। এ ক্ষেত্রে ৩২টি আন্তর্জাতিক সনদ অনুমোদন করতে হবে। অনুমোদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব ভালো করছে। ৩১টি অনুমোদন হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সনদ অনুমোদন বাকি আছে।’

শুধু সনদ অনুমোদন যথেষ্ট নয় বলে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, সনদগুলো বাস্তবায়নে পর্যবেক্ষণের বিষয় আছে। মানবাধিকার, পরিবেশ, শ্রমমান বিষয়ক উদ্বেগসহ অনেক বিষয় সুরাহা হতে হবে। বাংলাদেশ কঠোর পরিশ্রম করছে। শ্রমমান বিষয়ে এখন আন্তর্জাতিক কর্ম পরিকল্পনা আছে।

নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা

বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউয়ের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খাতে ইইউ উদীয়মান শক্তি। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ইইউ সহযোগিতার সুযোগ আছে। তবে কিভাবে সহযোগিতা করবে, তা আগামী বছরের প্রথম দিকে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক বৈঠকে আলোচনা হতে পারে।

নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা প্রসঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, এখানে সব পক্ষের আগ্রহ আছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্যারিসে আলোচনায়ও তা প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কৌশলগত অবস্থান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি—সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।

ইইউয়ের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত হোয়াইটলি বলেন, ‘আমাদের আইপিএস চীন বা কারো বিরুদ্ধে নয়। চীন ইইউয়ের কৌশলগত অংশীদার।’

ইইউ দূত আরো বলেন, “আমরা নিশ্চিত করতে চাই, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, উন্নয়ন সহযোগিতা, বাণিজ্য ইস্যুতে আমরা এই অঞ্চলের সঙ্গে সঠিকভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছি। বাণিজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বাণিজ্যের জন্য ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

সংখ্যালঘু ও অন্যান্য

সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব ঠেকাতে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের প্রত্যাশা, এসব পদক্ষেপ অপরাধীদের কার্যকর বিচার এগিয়ে নেবে।

টিকা

কভিড টিকার ক্ষেত্রে ইইউয়ের সহযোগিতা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত হোয়াইটলি বলেন, বাংলাদেশকে নেদারল্যান্ডস, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড টিকা দিচ্ছে। এটি চমৎকার অগ্রগতি। সমালোচনা ছিল, ইইউ টিকা দিচ্ছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন টিকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক বাংলাদেশকে টিকা ও অবকাঠামো উন্নয়নে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে।

শরণার্থী ও মানবিক সুরক্ষার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, গত বছর ইইউতে মোট ‘আশ্রয়প্রার্থীদের’ আবেদনের ৪০ শতাংশ গৃহীত হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত অভিবাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, মানবপাচার মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিভাবানদের কিভাবে ইইউতে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে ডিকাব সভাপতি পান্থ রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মঈনুদ্দিন বক্তৃতা করেন।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ