আওয়ামী লীগের ৬৮ বছর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ

আবদুল মান্নান

নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৬৮ বছর পার করল। আজ এই ঐতিহাসিক দলটির ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

দলের সঙ্গে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেসব নেতাকর্মী দলের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জড়িত ছিলেন তাঁদের প্রাণঢালা অভিনন্দন। ‘আদর্শে উদ্বুদ্ধ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করতে হলো এ কারণে, এই দলে বর্তমানে অসংখ্য অতিথি পাখি তথা হাইব্রিড কিলবিল করছে, প্রতিটি মুহূর্তে নানা ধান্দা আর ফন্দিফিকিরে ঘুরছে আর এই কালজয়ী দলটির সর্বনাশ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। শুধু একজন শেখ হাসিনার কারণেই এখনো বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল ও যাঁরা এ দেশে সুস্থ রাজনীতি আর অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা করেন, তাঁদের জন্য আওয়ামী লীগই শেষ ভরসাস্থল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আরডিসি) বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘দি ডেইলি ইনডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার সঙ্গে এক যৌথ জরিপ চালিয়ে এই উপসংহারে উপনীত হয়েছে যে জরিপে অংশগ্রহণকারী ২.৬ শতাংশ উত্তরদাতা আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন আর বিএনপির ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ২৫.৪ ভাগ। আরডিসির প্রধান কর্ণধার যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ফরেস্ট কুকসন। কুকসনকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতি সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ মনে করা হয়। কিছুদিন আগে করা ওয়াশিংটনভিত্তিক ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের চালানো জনমত জরিপের ফলাফল আরডিসির ফলাফলের বেশ কাছাকাছি। এসব আপাত ভালো খবর নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার  ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস নাগাদ দলটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন দলের জন্য একটি বড় অগ্নিপরীক্ষা। তবে আশার কথা হচ্ছে, আরডিসির জরিপমতে, দলের প্রধান ও দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পক্ষে ভালো মত প্রকাশ করেছেন ৭২.৩ শতাংশ উত্তরদাতা। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, তরুণদের ৭১ শতাংশের কাছে শেখ হাসিনা জনপ্রিয়। তবে এসব জনমত জরিপের ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ যদি তার ৬৯তম বছরে পথচলা শুরু করে, তা হলে ভুল হবে।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে জন্ম আওয়ামী মুসলিম লীগ বা বর্তমান আওয়ামী লীগের। প্রথম কমিটিতে সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক। যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন সে সময়ের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়াম শব্দটি উর্দু, যার অর্থ জনগণ আর লীগের অর্থ জনগোষ্ঠী। সুতরাং আওয়ামী লীগের অর্থ জনগণের গোষ্ঠী, মানে জনগণের দল। একটু ব্যাখ্যা করে বললে হবে, জনগণের জন্য জনগণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জনগণের দল। দলটি এমন একসময় প্রতিষ্ঠিত, যখন অবিভক্ত পাকিস্তানে রাজনৈতিক দল মানে জিন্নাহর মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। গঠনের সময় এটি তেমন একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা হয়নি। প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য আর ঢাকার গুটিকয়েক মুসলিম এলিট। সন্ধ্যা হলে প্রতিষ্ঠাতারা নবাবদের বাইজির নাচঘরে একত্র হয়ে কিছু আনন্দঘন মুহূর্ত কাটাতেন। মাঝেমধ্যে ‘হিন্দু ভারতে’ তাঁদের স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন কংগ্রেসের একজন মধ্যম সারির নেতা। ইংরেজরা ভারত ছাড়লে হিন্দু-মুসলমান কিভাবে একসঙ্গে বসবাস করতে পারে তিনি সেই চেষ্টা করেছেন। একসময় যখন তাঁর ধারণা হলো তা সম্ভব নয়, তখন তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে তাকে তার প্রতিষ্ঠাতাদের কাছ থেকে ছিনতাই করলেন। নেতৃত্বে নিয়ে আসলেন উত্তর ভারতের কিছু বিত্তশালী মুসলমান ভূস্বামী আর জোতদার; যাঁদের জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাঁদের নিয়ে জিন্নাহ ভারতের কোটি কোটি অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত সমাজে পিছিয়ে পরা মুসলমানদের এই ভ্রান্ত ধারণা দিলেন যে ইংরেজরা ভারত ছাড়লে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি প্রয়োজন। যাঁরা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সম্ভবত ব্যতিক্রম ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি শরৎ বসু, আবুল হাসিম, কিরণ শংকর রায়ের সঙ্গে অবিভক্ত বাংলার দাবিকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। সরল সাধারণ মুসলমানরা বুঝতে পারেনি যে জিন্নাহ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য যে পাকিস্তানের কথা বলছেন, সেটি বাস্তবায়ন হলে তা তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে না, করবে মূলত উত্তর ভারত আর পাঞ্জাবের বিত্তবান মুসলমানদের ছোট এক জনগোষ্ঠীর। এটি প্রথমে বুঝতে পেরেছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা। তারা এটি উপলব্ধি করেছিল যে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে ঠিক, তবে তা তাদের স্বার্থ রক্ষা না করে করছে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর। পাঞ্জাবিরা ছাড়া পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের মানুষ অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হলো। পূর্ব বাংলা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের মানুষ তেমন একটা রাজনীতি সচেতন ছিল না। তাদের নেতৃত্বেরও অভাব ছিল। পূর্ব বাংলার বাঙালিদের সৌভাগ্য যে এখানে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ, আবুল মনসুর আহম্মদ, কফিলউদ্দিন চৌধুরীর (ডা. বদরুদ্দোজার বাবা) মতো রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা ছিলেন। শেখ মুজিব (পরবর্তীকালে তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা) তখন তরুণ ছাত্রনেতা। দেশ ভাগের পরপরই তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য গঠন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পাকিস্তানের প্রথম মুসলিম লীগবিরোধী সংগঠন। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে বাঙালিদের দ্বারা গঠিত যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। বাঙালিদের এই অসামান্য বিজয়ের পেছনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আর নির্বাচনে একজন মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেছিলেন তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব, শামসুল হকসহ অন্য ছাত্রনেতারা।

১৯৪৯ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ পরবর্তীকালে নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নেতৃত্ব দলকে একটি অসাম্প্রদায়িক দলে রূপান্তর করেন। তখন এটি ছিল একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এটি বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতারা যেভাবে অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা চর্চা করতেন, তা দলে সেভাবে আর  চর্চা হয় না, আর এটির অন্যতম কারণ দলে আওয়ামী লীগের আদর্শ ধারণ না করার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আওয়ামী লীগের ৬৮ বছরের ইতিহাস দুর্গম পথ চলার ইতিহাস, চড়াই-উতরাই পার হওয়ার ইতিহাস। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচনা হওয়ার পর এটি নির্ধারিত ছিল যে ১৯৫৭ অথবা ১৯৫৮ সালে  নতুন সংবিধানের অধীনে পাকিস্তানে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের সন্তোষে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ধারণা হলো, নির্বাচন হলে পাকিস্তানে পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের আধিপত্য খর্ব হয়ে যাবে। নির্বাচন বানচাল করার জন্য পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান সংবিধান স্থগিত করেন আর পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করে সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সংবিধান বাতিল করে দেন। আওয়ামী লীগের সব নেতাসহ অন্য রাজনৈতিক নেতারা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আইয়ুব খান পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেশ শাসন করলেন।

১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ দলের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করলে তাঁকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগে দ্বিতীয়বারের মতো বিভক্তি দেখা যায়। দলের সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। একই কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবকে সভাপতি আর তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে দল পুনর্গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ ঘোষিত ছয় দফা সারা দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে, ছয় দফার ভেতরই লুকিয়ে আছে বাঙালির স্বাধীনতার বীজ। আইয়ুব খান শেখ মুজিবসহ তাঁর প্রায় সব রাজনৈতিক সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করেন আর তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে সামরিক আদালতে বিচারের নামে বঙ্গবন্ধু আর সহকর্মীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন। কিন্তু আইয়ুব খানের সব ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায় উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের তোড়ে, যার নেতৃত্বে ছিল এ দেশের ছাত্রসমাজ। গণ-আন্দোলনে শুধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাই ভেসে যায়নি, আইয়ুব খান নিজেও ক্ষমতাচ্যুত হন। নতুন সামরিক শাসক হয়ে আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এসেই তিনি ঘোষণা করেন ১৯৭০  সালের শেষ নাগাদ দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সেই নির্বাচনের পর নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি নিজ পেশায় ফিরে যাবেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচন শুধু বাঙালির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল না, আওয়ামী লীগের জন্যও একটি ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ ছিল, যা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি আর আওয়ামী লীগ অর্জন করেছে। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল (১৬৭/৩১৩)। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ছিল ছয় দফা। সেই নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মোট ৯৪.৪ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছিল; আর এই ভোটারদের ৭৫.১০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগ তথা ছয় দফাকে সমর্থন জুগিয়েছিল। সাধারণ নিয়মে বঙ্গবন্ধুই নির্বাচিত হওয়ার কথা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র কখনো এটা মেনে নিতে পারেনি যে তাদের শাসনক্ষমতা বাঙালিদের হাতে চলে যাবে। শুরু হলো ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে সরকার গঠন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দুরূহ কাজটি হাতে তুলে নেন এবং সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশটাকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দেন। এটি বললে অত্যুক্তি হবে না, বাংলাদেশে গত চার দশকে যত সরকার দেশ শাসন করেছে, বঙ্গবন্ধুর সেই সাড়ে তিন বছরের সরকারের মতো এত কঠিন সব চ্যালেঞ্জ অন্য কোনো সরকারকে মোকাবেলা করতে হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে দেশের শত্রুরা সপরিবারে হত্যা করলে আওয়ামী লীগ আবার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে, যদিও বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত ঘোষণা করে বাকশাল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু বাকশালের মূল নেতৃত্বেই ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। দলটিকে সম্পূর্ণভাবে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে কারাগারে বন্দি জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা—শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে ঘটনাচক্রে বেঁচে যান। জেল হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জিয়া। যেহেতু আওয়ামী লীগের গঠন, তার বেড়ে ওঠা একটি আদর্শের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল সেহেতু এই দল বারবার সংকটে পড়লেও রূপকথার সেই ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্বার জেগে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দলের ক্রান্তিকালে দলের হাল ধরেছিলেন বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, আবদুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ নেতা। তাঁরা সবাই বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন। তবে তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন এই দলকে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে বঙ্গবন্ধুর একজন উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব অপরিহার্য। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের এক বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে প্রবাসে নির্বাসন জীবনযাপনকারী শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতভাবে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সেই বছর ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশের এক ক্রান্তিকালে দেশে ফেরেন, যখন দেশে জেনারেল জিয়া সব প্রতিপক্ষকে দমন করে একজন একনায়কের মতো দেশ শাসন করছেন। কাকতালীয়ভাবে ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে জিয়া বিদ্রোহী সেনাদের হাতে নিহত হন।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯১ সালে দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ নানা ষড়যন্ত্রের জাঁতাকলে পড়ে সংসদে বিরোধী দলে বসতে বাধ্য হয়। এটি ছিল শেখ হাসিনার প্রথমবারের মতো পিতার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সংসদে প্রবেশ। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পায়। খুব কম দেশেই একটি দল ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে ক্ষমতায় ফিরতে সক্ষম হয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এটি সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের দ্রুততার কারণে। বর্তমানে তিনি শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, বিশ্বেও একজন স্বীকৃত রাষ্ট্রনায়ক, যাঁর কাছ থেকে বিশ্বের অন্যান্য নেতা শিখতে চান অনেক কিছু।

আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে শুধু অতীত চর্চা যথেষ্ট নয়। অতীত চর্চাটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে, বর্তমানে কথায় কথায় যারা বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগকে নিজের স্বার্থে পথে-ঘাটে ব্যবহার  করে, তাদের মনে করিয়ে দেওয়া, যে আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে সেই আওয়ামী লীগের  পেছনে যে ইতিহাস তা অনেক কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে। নতুন প্রজন্ম এই ইতিহাস না জানলে তাদের হাতে আওয়ামী লীগ কখনো নিরাপদ নয়; আর যেখানে আওয়ামী লীগে গত ২০ বছরে এত পরগাছার জন্ম হয়েছে সেগুলোকে সমূলে উৎপাটন না করলে বিপদ আসন্ন। দেশে সংখ্যালঘুদের জমি দখল থেকে শুরু করে টাকা পাচারের মতো এত ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে দলের যারাই জড়িত, তাদের নিয়ে আগামী নির্বাচনে সহজে পার পাওয়া কঠিন হবে। আওয়ামী লীগের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই হোক অঙ্গীকার—দল থেকে সব জঞ্জাল হটিয়ে এই ঐতিহাসিক দলটি আবার বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের দিকে যাত্রা শুরু করুক। তা একমাত্র তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাই করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয় দীর্ঘজীবী হোক। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি অমর হোক। জয় বাংলা।

 

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক