আইনের দুর্বল প্রয়োগে বেড়েছে খেলাপি ঋণ

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সার্বিকভাবে সম্পদের মান কমেছে। এতে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ও দেশে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দায় ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক সক্ষমতা কমেছে। ঋণ পরিশোধের বিধিমালা শিথিল করা হয়েছে। এতে ঋণ আদায় কমে গেছে। ব্যাংক খাতে ঋণ শৃঙ্খলা রক্ষা ও আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে আর্থিক সূচকগুলোর অবনতি হয়েছে। বেড়েছে খেলাপি ঋণ।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আর্থিক খাতের চিত্র ও সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সম্পদের মান খারাপ হয়েছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সম্পদের মান খারাপ হওয়ায় ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে। খেলাপি ঋণও বেড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চ ঝুঁকির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে এ হার সাড়ে ৯ শতাংশ। নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের হার আরও বেশি অর্থাৎ ২৩ শতাংশ।

খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ও ডলার সংকটের কারণে পন্যের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। মন্দার প্রভাবে উদ্যোক্তাদের আর্থিক সক্ষমতা কমেছে। এসব কারণে ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। ফলে খেলাপি বেড়েছে। এছাড়া ব্যাংক খাতে ঋণ শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ও আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে। এদিকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ বাড়ার পরও এগুলোকে প্রকাশ করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশের মতো শ্রীলংকাতে ব্যাংক খাতের সম্পদের মান কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খেলাপি ঋণের সবচেয়ে বেশি শ্রীলংকাতে ১১ শতাংশ। বাংলাদেশে সাড়ে ৯ শতাংশ। ভুটানে ৮ শতাংশ, পাকিস্তানে প্রায় ৮ শতাংশ, মালদ্বীপে ৬ শতাংশ, ভারতে ৫ শতাংশ ও নেপালে ২ শতাংশ।

নন-ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের শীর্ষে বাংলাদেশ, ২৩ শতাংশ, দ্বিতীয় অবস্থানে শ্রীলংকা ১৭ শতাংশ, পাকিস্তানে ৭ শতাংশ, ভারতে ৫ শতাংশ ও নেপালে ২ শতাংশ।
বাংলাদেশে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও আমানতের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন। বাংলাদেশে আমানতের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ, ভুটানে ৯ শতাংশ, ভারতে ৯ শতাংশ, নেপালে ৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ১২ শতাংশ ও শ্রীলংকাতে ১৫ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে আর্থিক খাতের দুর্বলতা বিশ্বব্যাপী গত মাচের মাঝামাঝিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাব অনেক দেশে পড়েছে। আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই পড়বে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ব্যাংক সংকটে পড়ায় ঋণ নীতিতে বড় ধরনের সংকোচন হয়েছে। এতে বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশের রপ্তানি কমে যেতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতির দিক থেকে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। শীর্ষে রয়েছে শ্রীলংকা ৬৪ শতাংশ, পকিস্তানে ৪২ শতাংশ, আফগানিস্তানের ১০ শতাংশ, বাংলাদেশে ৯ শতাংশ, নেপালে ৮ শতাংশ, ভারতে সাড়ে ৬ শতাংশ, ভুটানে ৬ শতাংশ ও মালদ্বীপে ৩ শতাংশ। বৈশ্বিক মন্দায় বাংলাদেশে গম ও জ্বালানি তেলের দাম বেশি বেড়েছে। এ কারণে এসব খাতের নেতিবাচক প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হার বেশি।

প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপে গড় মূল্যস্ফীতির হার দ্রুত বাড়ছে। এর লাগাম টেনে ধরতে হবে। তা হলে গড় মূল্যস্ফীতির বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। ভুটানে এ হার কমছে। কারণ সে দেশে আমদানি ও উৎপাদিত পণ্যের দাম কমছে। কিন্তু বাংলাদেশে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে।

বাংলাদেশে গ্রামে কেরোসিনের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এরপরই ভোজ্যতেল, পানীয়, খাদ্য পণ্য, মাছ, ফল, মাছ, মাংস ও ডালের দাম বেশি বেড়েছে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির হারও গ্রামে বেশি। ভারতে মসলার দাম বেশি বেড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ চাল রপ্তানি বন্ধ করেছে ২০২৩ সাল পর্যন্ত।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ছে বিনিময় হারের কারণে। এরপরই রয়েছে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি প্রধান ভূমিকা রেখেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে খাদ্য ও জ্বালানি খাতেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়ের তুলনায় পরিবারগুলোর খরচ কম। বাংলাদেশ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।

ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার ফলে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি কমেছে। কারণ বাংলাদেশ বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। রোজায় বেশি চাহিদা আছে এমন কিছু পণ্যের আমদানির শর্ত শিথিল করা হয়েছে। চাল, গম, ফল, ইঞ্জিন তেল, লুব্রিকেন্ট ও খাদ্যদ্রব্য আমদানির এলসি খোলার সুযোগ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশে চলতি হিসাবে অবনতি ঘটেছে। অন্যান্য বিনিয়োগের নিট হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। ঋণ বিতরণ কমে গেছে। সংকটে আত্মবিশ্বাসের অভাবে বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ কমিয়ে দিয়েছে।

ভারতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ নিম্নমুখী। বাংলাদেশে কিছুটা বিনিয়োগ হয়েছে। পোর্টফোলিও ও অন্যান্য বিনিয়োগ বাংলাদেশে কমেছে। চলতি হিসাবে ঘাটতি রেকর্ড হয়েছে।
ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে পাকিস্তানে, তারপরে শ্রীলংকায়। এরপর বাংলাদেশে তারপর ভারতের অবস্থান। বাংলাদেশে গড়ে এক বছরে ২৫ থেকে ৩২ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।

রিজার্ভ দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানোর দিক থেকেও বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্বল। বাংলাদেশে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান রিজার্ভ আছে, ভুটানে সাড়ে ৬ মাসের, ভারতে ৮ মাসের, নেপালে ৯ মাসের, পাকিস্তানে ২ মাসের ও শ্রীলংকায় দেড় মাসের।

বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রিত ভাসমান বিনিময় চালু আছে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করছে। তাদের হস্তক্ষেপেই এর দাম ওঠানামা করছে। করোনার মহামারির সময়ে আমদানি কম ও রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনেছে। পণ্যমূল্য বাড়ায় এখন বৈদেশিক খাতে চাপ বেড়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি, আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস ডলারের দাম জোগান বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রিজার্ভে। সূত্র: যুগান্তর