আইনজীবী হয়েও বাবার দর্জি ব্যবসা ধরে রেখেছেন রাজশাহীর হাবিবুর

নিজস্ব প্রতিবেদক:

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরই বাবার সঙ্গে দোকানে যাতায়াত শুরু করেন হাবিবুর রহমান। তখন তিনি কলেজছাত্র। এরপর আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। কিন্তু আইন পেশায় যোগ না দিয়ে বাবার ব্যবসা দর্জিতেই আস্থা রাখেন তিনি। এখনো সেই পেশা ধরে রেখেছেন সুনামের সঙ্গে। রাজশাহী নগরীর রানীবাজার (বাটার মোড়) এলাকায় দোকান তাঁর। ‘ড্রেসকো টেইলার্স’ নামের এই দোকানটির পরিচয় গোটা রাজশাহী অঞ্চলজুড়েই। এমনকি যেসব বড় বড় অফিসার রাজশাহী এসে একবার চাকরি করে গেছেন, তাঁরা পরবর্তি ঢাকা বা দেশের অন্য কোনো জেলা শহরে গেলেও এই ড্রেসকোতে এসে এখনো নিজের কোর্ট-প্যান্টটি ও শার্ট তৈরী করে নিয়ে যান।

কারণ আস্থা আর নিখুত কাজের জন্য এখনো বিখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটি। ফলে রাজশাহী ছাড়াও এই বিভাগের সব জেলা থেকেই খদ্দেররা আসেন তাঁর দোকানে কোর্ট-প্যান্ট ও শার্ট তৈরী করাতে।


হাবিবুর রহমান জানান, তাঁর বাবা আব্দুস শুকুর ১৯৫২ সালের দিকে রাজশাহীতে টেইলার্সের ব্যবসা শুরু করেন। এর আগে তিনি কলকাতা গিয়ে টেইলার্সের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে নগরীর রানীবাজার এলাকায় একটি দর্জির দোকান দেন। তাঁর বন্ধু মোতাহার হোসেন ইউনিক টেইলার্স নামে আরেকটি দোকান দেন। তাঁরা দুই বন্ধু পাশাপাশি প্রায় এই ব্যবসা শুরু করেন। তাঁরা দুই বন্ধু যখন এই ব্যবসা শুরু করেন, তখন রাজশাহীতে টেইলার্স ছিলো সাকুল্যে চারটি। ড্রেসকো নাম দিয়েই নিজের ব্যবসা শুরু করেন আব্দুর শুকুর। প্রথমে নারী-পুরুষ উভয় তাঁর দোকানের খদ্দের হলেও পরবর্তি ধিরে ধিরে শুধু পুরুষদের জন্য কোর্ট-প্যান্ট ও শার্ট তৈরী করতে থাকেন।

এই ব্যবসা দিয়েই আব্দুস শুকুর চার ছেলে-মেয়েকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁদের সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে দুই ছেলে বাবার রেখে যাওয়া পেশা ধরে রেখেছেন। আর দুই ছেলের মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আরেক অন্য ব্যবসা করেন।

তবে বাবার পেশাটি ধরে রেখেছেন হাবিবুর রহমান ও হামিদুর রহমান। এর মধ্যে বছর দুয়েক আগে হামিদুর রহমান আলাদা দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন। আর হাবিবুর রহমান এখনো বাবার রেখে যাওয়া দোকানটিতেই ব্যবসা করে যাচ্ছেন ঐতিহ্য আর সুনামের সঙ্গে।

হাবিবুর রহমান জানান, তাঁর দোকানে শুধু উচ্চবিত্তরাই আসেন শার্ট, প্যান্ট ও কোর্ট তৈরী করতে। তিনি এসবই তৈরী করেন শুধু। অন্য কোনো পোশাক তৈরী করেন না। তবে এসব পোশাক তৈরীর জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠানটির সুনাম পুরো রাজশাহী বিভাগজুড়েই রয়েছে। এ কারণে রাজশাহীর বাইরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জয়পুরহাট থেকেও ক্রেতারা ছুটে আসেন নিজেদের রুচিশীল পোশাক তৈরী করতে।

তাঁর বাবা যখন ব্যবসা করতেন, তখনো এসব জেলা থেকে খদ্দেররা ছুটে আসতেন। আর সেই সুনাম দিয়েই তিনি এখনো বাবার ব্যবসাটা ধরে রেখেছেন।

আবার কখনো বড় বড় সরকারী কর্মকর্তারা রাজশাহী এসে বদলি হয়ে ঢাকা বা দেশের অন্য কোথাও গেলেও এখনো কাপড় পাঠিয়ে দেন বা নিজেই চলেন আসেন পছন্দের পোশাক তৈরী করাতে ড্রেসকোতে। ফলে খদ্দের আগের চেয়ে কিছুটা কমে গেলেও ড্রেসকোর ব্যবসা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
হাবিবুর রহমান আরো বলেন, ‘এখন ভালো শ্রমিকের প্রচণ্ড শঙ্কট। বেড়েছে শ্রমিকের মজুরীও। আবার দর্জির দোকানের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ফলে আগের চেয়ে এখন খদ্দের কমেছে। কিন্তু আমাদের ব্যবসা ঠিকই চলছে সুনামের সঙ্গে।’

তিনি আরো জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর হাবিবুর রহমান যখন ব্যবসা শুরু করেন, তখন একটি শার্টের মজুরী ছিলো ৬-৭ টাকা। আর কোর্টের মজুরী ছিলো ৭০-৮০ টাকা।


এদিকে ড্রেসকোতে নিজের কোর্ট-প্যান্ট বানাতে আসা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আইনজীবী ড. তসিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানকার পোশাকের আলাদা চাহিদা আছে। রুচিসম্মতও। তাই বড় বড় কর্মকর্তাদের কাছে এখানকার পোশাক মানেই আলাদা কিছু। এ কারণে আমরা ভালো কিছু পোশাক বানানোর চিন্তা করলেই এখানে ছুটে আসি।