সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভারতীয় বিষাক্ত সাপসহ পোকামাকড়। যার ফলে লালমনিরহাটে সাপের কামড়ে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আর গ্রামের মানুষজন সাপে কাটলে হাসপাতালে না গিয়ে শরণাপন্ন হচ্ছেন ওঝা কিংবা কবিরাজদের কাছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গ্রামের নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। আর ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে সাপে কাটা অনেক রোগী ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে।
তবে এই দায় নিতে চান না ওঝা কিংবা কবিরাজরা। তাদের দাবি, বাংলাদেশের কয়েকটি বিষাক্ত সাপ কাটলে রোগীকে মাত্র ২৫ মিনিটে সুস্থ করতে পারেন তারা। তবে দেশের বাইরের বিষাক্ত সাপে কাটা রোগীর কোনো চিকিৎসা তারা দিতে পারেন না। আর সাপের কামড়ে মারা যাওয়া রোগীদের পরিবারের দাবি, সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোতে সাপের ভ্যাকসিনের (অ্যান্টিভেনম) সংকটের কারণে ওঝা বা কবিরাজদের কাছে যাচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, ২০২৩ সালে লালমনিরহাট জেলায় সাপের কামড়ে মারা গেছেন প্রায় ২৫ জন। যার মধ্যে অনেক শিশুও রয়েছে। গত বছর ভারতের সিকিমের বন্যায় তিস্তা নদী দিয়ে গাছপালাসহ অনেক মাছ ভেসে আসে। এর সঙ্গে ভেসে আসে বিষাক্ত সাপও। ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টার দিকে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের তেলিটারী গ্রামের কলেজছাত্র শরিফুল ইসলাম সিকিমের বন্যায় ভেসে আসা একটি সাপ ধরে কয়েকজন বন্ধু মিলে ভিডিও ধারণ করে। একপর্যায়ে ওই সাপ মাথায় কামড় দিলে দ্রুত শরিফুলকে বাড়িতে নিয়ে যায় সহপাঠীরা। পরে স্থানীয় এক ওঝা চিকিৎসা করেন। সেখানে ঝাড়ফুঁক দিয়ে ২৫/৩০ মিনিট ঘরে রাখতে বলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই শরিফুল বমি করতে শুরু করলে ওই ওঝা হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। ওঝার পরামর্শে পরে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার চেষ্টার পরও সদর হাসপাতালে ভ্যাকসিন (অ্যান্টিভেনম) না থাকায় রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পথে শরিফুল ইসলামের মৃত্যু হয়।
একই ঘটনা ঘটে পার্শ্ববর্তী উপজেলা কালীগঞ্জের দক্ষিণ দলগ্রাম এলাকায়। চাপারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমি আক্তার। পড়াশোনা শেষ করে পরিবারসহ রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমাতে যায়। পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার বিছানায় কম্বলের নিচে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা বিষধর সাপ ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে কামড় দেয়। পরিবারের লোকজন তা বুঝতে না পেরে স্থানীয়দের কথায় চাপারহাটের হরিদাস চন্দ্র রায় (নাড্ডা) কবিরাজের কাছে নিয়ে যান। সেখানে ১০/১৫ মিনিট ঝাড়ফুঁক করেন কবিরাজ। পরে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায় সুমি আক্তার।
সুমি আক্তারের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে হরিদাস চন্দ্র রায় (নাড্ডা) কবিরাজের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিবেদক। সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা কোথা থেকে শিখেছেন এমন প্রশ্ন করা হলে কিছুটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন হরিদাস চন্দ্র রায়। পরে বাধ্য হয়ে স্বীকার করেন, পশু চিকিৎসার পাশাপাশি কবিরাজি করেন তিনি।
ঢাকা পোস্টকে হরিদাস চন্দ্র রায় বলেন, আমার বাবা কবিরাজের চিকিৎসা দিয়ে এই এলাকায় অনেক সুনাম অর্জন করেছেন। তার কাছ থেকে আমি সাপে কামড়ের চিকিৎসা শিখেছি। মানুষ উপকার না পেলে কবিরাজের কাছে আসত না। তারা উপকার পাচ্ছে বলেই কবিরাজের কাছে আসে।
হরিদাস চন্দ্র রায় বলেন, আমি যা পারি সেই চিকিৎসা কেউ দিতে পারবে না। ওষুধ ছাড়াও আমার ব্যক্তিগত মন্ত্র আছে, সেটা দিয়ে একজন সাপে কাটা রোগীকে মাত্র ২০/২৫ মিনিটে সুস্থ করে দিতে পারি।
এই কবিরাজের দাবি, বাংলাদেশের যেকোনো বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে তিনি ভালো করতে পারেন। কিন্তু ভারত কিংবা পাহাড়ি সাপের চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করে এখনো তেমন কোনো উপায় পাননি তিনি।
অ্যান্টিভেনম নিয়ে পশু চিকিৎসক ও কবিরাজ হরিদাস চন্দ্র রায় বলেন, হাসপাতালে ভ্যাকসিন থাকা প্রয়োজন। কারণ একা এত রোগী ভালো করা আমার পক্ষে সম্ভব না। যদি হাসপাতালে ভ্যাকসিন থাকে তাহলে সহজে সাপের কামড়ে রোগীরা চিকিৎসা নিতে পারবেন।
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমি আক্তারের মা ফরিদা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, গ্রামের মানুষের কথায় কবিরাজের কাছে সুমিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ঝাড়ফুঁক দিয়ে সুস্থ না হলে কবিরাজ নিজেই হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার মেয়ে মারা যায়। যদি হাসপাতালে ভ্যাকসিন থাকত তাহলে আমার মেয়ে ওইদিন মারা যেত না। তাই হাসপাতালগুলোতে ভ্যাকসিনের রাখার দাবি জানাচ্ছি।
নিহত শরিফুল ইসলামের বড় ভাই ফরহাদ হোসেন বলেন, সাপে কামড় দেওয়ার পর ভাইকে গ্রাম্য কবিরাজ চিকিৎসা দেন। পরে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসকদের সাপে কামড়ের কথা জানালেও তারা ভ্যাকসিন নেই বলে জানিয়ে দেন। জেলার সদর হাসপাতালে যদি ভ্যাকসিন না থাকে তাহলে যাদের সাপে কামড় দেবে তারা কোথায় যাবে। তাই আমাদের দাবি দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যেন ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা হয়। না হলে গ্রামের অসহায় মানুষ সাপের কামড়ে মারা যাবে। আর টাকা হাতিয়ে নেবে ওঝা ও কবিরাজরা।
সাপের কামড়ে মারা যাওয়া সুমি আক্তারের চাচি দুলালি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামের অনেক লোকজন আছেন যারা কবিরাজের পক্ষে কাজ করেন। অসহায় রোগীরা যখন এ ধরনের বিপদে পড়েন তখন তারা এসে কবিরাজের কাছে যেতে পরামর্শ দেন। আমরাও না বুঝে গ্রাম্য কবিরাজের কাছে নিয়ে যাই। আর হাসপাতালগুলোতে ভ্যাকসিন থাকলে কখনই আমাদের রোগীকে কবিরাজের কাছে নিয়ে যেতাম না। আমরা দ্রুত হাসপাতালগুলোতে ভ্যাকসিন চাই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় বলেন, মানুষের সচেতনতার অভাবে ওঝা ও কবিরাজরা সুযোগ নিচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা সব সময় সচেতনতামূলক সেমিনার করছি। এতে করে সাধারণ মানুষ গ্রাম্য চিকিৎসক ও কবিরাজের কাছে আগের থেকে কম যাচ্ছে। আর বিষাক্ত সাপের কামড়ে দ্রুত ভ্যাকসিন নিতে হবে। মূলত বাংলাদেশের বেশির ভাগ সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কবিরাজরা তাদের কাছে টাকা নিচ্ছে। কখনো যদি সাপে কামড় দেয় তবে অবশ্যই সেই রোগীকে চিকিৎসক অথবা হাসপাতালে এনে চিকিৎসা নিতে হবে।
অনেকেই হাসপাতালে এসে অ্যান্টিভেনম পাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে সিভিল সার্জন বলেন, মূলত কয়েক দিন আগে অনেকগুলো অ্যান্টিভেনম মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় অ্যান্টিভেনমের কিছুটা সংকট ছিল। এ কারণেই তারা এ অভিযোগ করছে বলে আমার ধারণা।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে অ্যান্টিভেনম চলে এসেছে। সাপে কাটা রোগীরা এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই চিকিৎসা নিতে পারবেন।