অর্থনীতি থেকে রাজনৈতিক সহযোগিতায় উত্তরণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মধ্যে সম্পর্ক আটকে না রেখে সেটিকে কৌশলগত পর্যায়ে নিচ্ছে ঢাকা ও বেইজিং। দুই দেশ তাদের সম্পর্ক নিবিড় করতে উচ্চপর্যায়ে রাজনৈতিক যোগাযোগ বাড়াবে। বাংলাদেশের অবকাঠামো, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে চীন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ দমন, বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভের (অঞ্চল ও পথের উদ্যোগ) মতো সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।

তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সব মিলিয়ে এই সফর দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে বিপুল উচ্চাশা ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তেমনি এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঝুঁকিও আছে। এই সফরে নেওয়া সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উন্নয়নে মৌলিক পরিবর্তনের সুযোগ আছে। তাই স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জোর দেওয়া উচিত।

এদিকে যেকোনো কৌশলগত সম্পর্কে নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্ত থাকলেও বাংলাদেশ-চীনের ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ শুধু দুই দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের স্বার্থে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে চিরাচরিত নিরাপত্তার কোনো উপাদান নেই বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকেরা। তবে তাঁদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

কৌশলগত অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় সম্পর্কের কোন বিষয়গুলো যুক্ত, জানতে চাইলে সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিল্প-সাহিত্য—সবকিছু…নিরাপত্তা, সবকিছু জড়িত। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়। চীনের সঙ্গে আমাদের অনেক কিছু আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের এই অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা। এটা আমাদের অগ্রাধিকার।’ গতকাল শনিবার সকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীনের প্রেসিডেন্টকে বিদায় জানানোর পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সৈয়দ আশরাফ।

দুই দিনের সফর শেষ করে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং গতকাল সকালে ভারতের গোয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। বিমানবন্দরে তাঁকে বিদায় জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা ছাড়ার আগে সকালে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সি চিন পিং।

চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে দুই দেশের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই দেশের অতীতের সফরের সঙ্গে এবারের পার্থক্য হচ্ছে সম্পর্কটা শুধু ব্যবসা আর বিনিয়োগে সীমিত নেই। দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব সম্পর্কে রাজনৈতিক উপাদান যুক্ত করতে উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কৌশলগত অংশীদারত্বের মাধ্যমে দুই দেশের উন্নয়নের পরিকল্পনাকে এক সুতায় গেঁথে নিতে চায় দুই দেশ। সব মিলিয়ে সম্পর্ক নতুন পথে নেওয়ার একটা পথনির্দেশনা পাওয়া যায় এসব সিদ্ধান্তে।

ঢাকায় চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত চাই সি মনে করেন, সি চিন পিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের পথনির্দেশনা দিয়েছে। বার্তা সংস্থা সিনহুয়াকে তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্তরের উচ্চপর্যায়ে পারস্পরিক আস্থা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ককে নতুন ধাপে নেওয়ার এটাই সঠিক সময়। আর এটি যথার্থতার সঙ্গে করা হয়েছে।

চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের মূল্যায়ন জানতে চাইলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, এর চেয়ে আর কোনো ভালো সফর হতে পারে না। এই সফরে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সুযোগ যেমন তৈরি করেছে, তেমনি তা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জও আছে। তবে এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।

সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি বেশ আন্তরিক ছিল। দুই দেশ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ইতিহাসের কথা বলেছে। অবধারিতভাবেই এসেছে চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চো এন লাইয়ের ঢাকা সফর ও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চীন সফরের প্রসঙ্গ। চীনের প্রেসিডেন্টের বার্তা ছিল, তিনি বন্ধুর কাছে এসেছেন। আর বাংলাদেশের বার্তা ছিল, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্ব। চীনের প্রেসিডেন্ট এ সময় দুই দেশের স্বপ্ন পূরণে একসঙ্গে যাত্রার কথাও বলেছেন। এ প্রসঙ্গে এক কর্মকর্তার মত হচ্ছে, শুধু ব্যবসা দিয়ে সম্পর্ক নিবিড় করা যায় না। সম্পর্কে গভীরতার জন্য রাজনৈতিক উপাদান জরুরি। এবারের সফরে দুই দেশ তা করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবীর মনে করেন, চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কের ভবিষ্যৎ পথরেখা তুলে ধরছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, এ বিষয়গুলোর সবই অঙ্গীকার। আর এই অঙ্গীকার সফল বাস্তবায়নের জন্য আলোচনার প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতি, সক্ষমতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

কৌশলগত অংশীদারত্বে নিরাপত্তার উপাদান আছে কি না, জানতে চাইলে হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘কৌশলগত শব্দটি এলেই তার মানে চিরাচরিত নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবলে চলবে না। উন্নয়নের সঙ্গে নিরাপত্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রোধ হলে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়ক হয়। কাজেই সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই কৌশলগত অংশীদারত্ব ইতিবাচক বলেই বিবেচনা করি।’

বাংলাদেশ এই প্রথম বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় রাজি হলো। বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এই পর্যায়ের সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, চীনের সঙ্গে গত চার দশকের যে সম্পর্ক, তাতে কোনো একটি বিষয়ে এখন পর্যন্ত দূরত্ব তৈরি হয়নি। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনায় সম্পর্কে গভীর আস্থার বিষয়টি এসেছে। কাজেই সম্পর্কের আস্থার বিষয়টি পরীক্ষিত বলেই তা কৌশলগত—এ নিয়ে দুই দেশ দ্বিধা করেনি।

সংশ্লিষ্ট অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, দক্ষিণ চীন সাগরের পরিস্থিতি, বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মতো প্রসঙ্গগুলো আলোচনায় তোলেনি চীন।

এক অঞ্চল, এক পথে যুক্ততার গুরুত্ব তুলে ধরে এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, এই উদ্যোগে এর মধ্যেই শতাধিক দেশ সমর্থন দিয়েছে। আর ৩৩টি দেশ ইতিমধ্যে এই প্রক্রিয়ায় চীনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সিল্ক রুট ফান্ডের জন্য প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল রেখেছে চীন। ফলে এতে যুক্ত হয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা পাবে বাংলাদেশ।

জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাদের নিজেদের অদক্ষতা, সুশাসনের কারণে হোঁচট না খেলে চীনের এই বিপুল বিনিয়োগ বাংলাদেশের উন্নয়নে মৌলিক পরিবর্তন আনবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সবকিছুর সাফল্য নির্ভর করছে এই সুযোগকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগানোর ওপর।’

সূত্র: প্রথম আলো