অভিযোগ নির্ভর দুদক

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দিন দিন অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। সেই তুলনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতির অনুসন্ধানের ঘটনা নেই বললেই চলে। অনুসন্ধানের কথা আইনে থাকলেও দুদক কাজ করছে অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে। এজন্য কমিশনের অনিচ্ছা ও অভিযোগের চাপের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা না থাকাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দুদক কর্মকর্তা জানান,স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতি অনুসন্ধানের সুযোগ দুদকের রয়েছে। কিন্তু এতে কমিশনের আগ্রহ কম। জনবল সংকট, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যাওয়ার অনীহা এবং কোনও বিষয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে কর্মকর্তাদের শেষ পর্যন্ত ডিসক্রেডিটেড হওয়ার আশঙ্কাকেই অনাগ্রহের কারণ।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৪ মে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করে কমিশন। এ অনুযায়ী,  গত বছর কমিশনে ১২ হাজার ৯৯০টি অভিযোগ আসে। এর মধ্যে এক হাজার ৭টি অনুসন্ধানের জন্যে বিবেচিত হয়। ৫৮৮ অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগে পাঠানো হয়। ২০১৫ সালে কমিশনে অভিযোগ এসেছিল ১০ হাজার ৪১৫টি। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে দুই হাজার ৫৭৫টি অভিযোগ বেশি এসেছে। এই পরিসংখ্যান থেকে দুদক দাবি করছে, তাদের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি হয়েছে।

গত দুই বছরের মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬ সালে ৩৫৯টি দুর্নীতির মামলা করে দুদক। ২০১৪ সালে ৩৩৩টি এবং ২০১৫ সালে ৫২৭টি মামলা করা হয়। এরমধ্যে ফাঁদ পেতে ২০১৬ সালে ১৩টি অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার করা হয়। আর ২০১৫ সালে ৪টি ও ২০১৪ সালে ৫টি মামলা করা হয়।

স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতি অনুসন্ধানের পর কর্মকর্তাদের ডিসক্রেডিটেড হওয়ার আশঙ্কার বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন পরিচালক বলেন, ‘অনুসন্ধান করার পর ভবিষ্যতে মামলা মোকাদ্দমা না হলে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের জন্য ডিপার্টমেন্টে এটা ডিসক্রেডিট। এজন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। অনেকাংশে এটি করাই হয় না।’

ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনও চাপ নেই বলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ একাধিকবার দাবি করলেও অদৃশ্য একটা চাপ রয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক দুদক কর্মকর্তা।

পরিসংখ্যানে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনুসন্ধানের বিষয় উল্লেখ বা সংখ্যা না থাকলেও এভাবে অনুসন্ধান করা হয় বলে দাবি করেছেন দুদকের সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ‘দুদক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনুসন্ধান করে। কিন্তু এ সংখ্যা কম। বিভিন্ন কারণে এটি করা হয় না। তবে ধীরে ধীরে এটি বাড়বে।’

এ বিষয়ে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘আমি যখন ছিলাম, সংবাদপত্রের সংবাদের ভিত্তিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক ইনকয়ারি হয়েছে। প্রকাশিত এসব দুর্নীতির ঘটনার বিষয়ে অনুসন্ধান কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই নেওয়া হয়। আমার সময়ে হলমার্ক, ডেসটিনি– এগুলো পত্রিকার খবর থেকেই আমলে নিয়েছে দুদক। এখনও হয়তো এভাবে দুদক অনুসন্ধান করে। আবার নাও করতে পারে। তবে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের পর সেগুলো কমিশন অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিলে দুদকের কাজটা সহজ হয়।’

আবার ঢালাওভাবে যে কারও বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধানে নামলে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘তথ্যের কোনও ভিত্তি ছাড়া কারও বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা ঠিক হবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া যে কারও বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান করলে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। আবার এতে কমিশনের কোনও কোনও কর্মকর্তার মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতাও দেখা দিতে পারে।’

দুদক অভিযোগ ভিত্তিক অনুসন্ধানের পাশাপাশি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনুসন্ধান না করার দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন,‘আইনগতভাবে দুদকের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতি অনুসন্ধানের এখতিয়ার রয়েছে। সেটা হোক আমরাও চাই। দুদকের সঙ্গে আমরা বিভিন্ন সময় যে কাজগুলো করি, তখন এই বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুটি কারণে দুদক সেটা করতে পারছে না বা আগ্রহ কম দেখায়। একটা হলো– দুদকে যেসব অভিযোগ প্রতিনিয়ত আসে, সেগুলো নিয়েই তাদের অনেক কাজ করতে হয়। ফলে অভিযোগের বাইরে গিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করার সুযোগ সেই অর্থে তারা হয়তো পায় না। এরমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের একটি বিষয়ও থাকে। চাহিদা অনুযায়ী লোকবলও কম। আরেকটা বিষয় হলো– জনগণ বা আমরা যেটা আশা করি যে, দুদক কোনও একটা বিষয় নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করবে কিন্তু তারা অনেক ক্ষেত্রেই তা করতে পারেন না। দেখা যায়, এসব দুর্নীতির সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সম্পৃক্ততা থাকে। ফলে কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করার মতো এতটা শক্তি দুদকের মনে হয় নেই।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন