অফিস করেন না রাজশাহী যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেটি জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি এলাকায় অবস্থিত। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশে সবুজেঘেরা পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। বাইরে থেকে এই প্রদিষ্ঠানটিকে দেখতে একটা নির্মল পরিবেশের আবহ ভেসে আসে; কিন্তু ভিতরে গেলেই সেই চিত্রের যেন পুরোটা উল্টো দেখা যাবে।

ভিতরের অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যালয় থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসিক ভবনটিও জীর্ণদশা। ভবনগুলোর কোনো কোনেটির জানালা নাই তো, কোনোটির কোথাও কোথাও টিনের চালারও একেকটি অংশ উড়ে গেছে। আবার গোটা প্রশিক্ষণকেন্দ্র জুড়েই বিভিন্ন স্থানে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির অফিসকক্ষের চেয়ার-টেবিলগুলোতেও যেন ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে।

কারণ অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীই নিয়মিত অফিস করেন না। ফলে এক ভুতুড়ে কেন্দ্রেই পরিণত হয়েছে রাজশাহী যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি। গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের।

নগরী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাজশাহী যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিতে সকাল পৌনে ১০টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, একজন প্রশিক্ষক শেণিকক্ষে ক্লাস করাচ্ছেন। আর অফিসকক্ষে বসে আছেন একজন অফিস সহকারী। বাইরে ঘুরা-ফেরা করছিলেন একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। অফিসের অন্যান্য কক্ষগুলোতে তখন ফাঁকা পড়ে আছে চেয়ার-টেবিল।

নিয়ম অনুযায়ী সকাল নয়টার পর থেকেই এই অফিসটি সরগরম হওয়ার কথা। কারণ সকাল সাড়ে নয়টা থেকেই প্রশিক্ষণার্থীদের ক্লাস শুরু হয়; কিন্তু একটি ক্লাস হয়ে যাওয়ার পরেও অন্যান্য কর্মকর্তা এবং প্রশিক্ষকরা তখনো আসেননি। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অপর একজন প্রশিক্ষক এসে পৌঁছেন।

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, তাঁরা গত ১ মার্চ থেকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এর মধ্যে প্রশিক্ষণকেন্দ্রের কো-অর্ডিনেটর মতিউর রহমানকে কয়েকবার দেখেছেন। আর অন্যান্য প্রশিক্ষকদের মধ্যে ডেপুটিশনে আসা ফাহমিদা সারোয়ার নামের একজন সিনিয়র প্রশিক্ষককেও (কৃষি) কয়েকবার দেখেছেন। এই দুই কর্মকর্তা অধিকাংশ দিনই অফিসে আসেন না। এর বাইরে অন্যান্য প্রশিক্ষকরাও অনিয়মিত অফিস করেন। ফলে অফিস কক্ষগুলো পড়ে থাকে ফাঁকা।


কেন্দ্রটির একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইবনে মোতাইন সারা মাসের এক থেকে দুই-দিন অফিস করেন। মাসের একদিন যান বেতন ওঠাতে। আরেকদিন যান সারা মাসের হাজিরায় স্বাক্ষর করতে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশের গ্রাম রাজাবাড়ির এই প্রভাবশালী কর্মচারীর দাপটে অতিষ্ঠ সবাই। কারণ বছর চারেক আগে তিনি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কো-অর্ডিনেটর আব্দুল মান্নানকে পিটিয়ে তাঁর কক্ষেই আটকে রেখেছিলেন। পরে কেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে দরজা ভেঙে আব্দুল মান্নানকে তাঁর কার্যালয় থেকে উদ্ধার করেছিলেন। এরপর ওই কর্মচারী ইবনে মোতাইনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করাও হয়েছিল।

পাশাপাশি তাঁর বেতনও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল শাস্তিস্বরুপ। পরবের্তিতে চাকরি ফিরে পেলেও এখনো প্রতাপশালী ইবনে মোতাইন। অফিসে তাঁর আচরণ যেন তিনিই বস। এ কারণেই ক্ষমতার দাপটে তিনি নিয়মিত অফিস করেন না বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কেউ ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না।

তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ইবনে মোতাইয়েন সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত অফিস করি। এই ধরনের অভিযোগ ঠিক নয়। তবে কো-অর্ডিনেটরকে মারপিটের বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি।

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষনার্থীা জানান, তাঁদের আবাসন কক্ষটি একেবারে জরাজীর্ণ। যেন থাকার উপায়ও নাই। কিন্তু সেই কেন্দ্রটিই কয়দিন আগে সংস্কারের নামে প্রায় সাত লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। দুই অংশের দুটি দেয়ালে হালকা রং-চুনকাম করেই টাকাগুলো লুটপাট করা হয়েছে। যদিও ঢাকা থেকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের একজন প্রকৌশলীর নেতৃত্বে হয়েছে এই লুটপাট। অথচ ভাঙা-চোরা ভবনটির অধিকাংশ কক্ষই একেবারে থাকার অনুপযোগী পরিত্যক্ত।

সরেজমিন ঘুরে আরো দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাতটি কোয়ার্টার আছে। সেগুলোও পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয়েছে। কারণ এখানে প্রশিক্ষকরা থাকেন না। তাঁরা সবাই যে যার মতো বাইরে থেকে এসে অফিস করেন। এতে করে সঠিক মাণের প্রশিক্ষণও হচ্ছে না। কোনো মতে তিন মাস পার করেই প্রশিক্ষণ শেষ করে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে সনদ। ফলে সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অথচ প্রতি তিন মাসে লাখ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে ৪০ জন করে প্রশিক্ষকদের মাঝে।

এসব নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কো-অর্ডিনেটর মতিউর রহমান বলেন, ‘আমি নিয়মিত অফিস করি না, এটা ঠিক নয়। নানা কাজের জন্য ঢাকায় থাকতে হয়। এ কারণে মাঝে মাঝে অফিস করতে পারি না। তবে আমার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সার্বিক অবস্থা দেখে কর্তৃপক্ষ খুশি। যদিও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা কাজ নিয়ে ঝামেলা আছেই। তবে এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।’

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির জরাজীর্ণ পরিবেশ সম্পর্কে বলেন, ‘সবগুলো ভবনই দীর্ঘদিনের পুরনো। এ কারণে ভবনগুলোতে বসবাস করায় দায়। এমনকি অফিসটিও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। তার পরেও আমরা কোনো মতে ব্যবহার করছি। তবে আশা করি দ্রুতই আমাদের উন্নত মাণের ভবন হবে। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে কাজও শুরু হয়েছে।’

স/আর