অন্যের ঘরে প্রবেশে অনুমতি জরুরি

স্থূল দৃষ্টিতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কিছু কিছু সুন্নাতকে সাধারণ মনে হলেও পরকালে এর বিনিময়ে এমন পুরস্কার রয়েছে, যা মানুষের কল্পনায়ও আসা অসম্ভব। এমনকি একেকটি সুন্নাতের ইহকালীন ও জাগতিক এত উপকার রয়েছে, যার একটি উপকার অর্জনের জন্যও মানুষ তার জীবনের বেশির ভাগ শ্রম, মেধা ও সম্পদ উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু আজ অন্য মানুষ তো দূরের কথা, মুসলমানরাও তাদের প্রিয় নবীর সুন্নাত পালন থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বেখবর। নিম্নে এমনই একটি অবহেলিত সুন্নাত নিয়ে আলোচনা করছি। তা হলো—কারো ঘরে বা বিশেষ কক্ষে অনুমতি ও সালামের মাধ্যমে প্রবেশ করা। এটি একটি কোরআনি বিধান। এটি লঙ্ঘনের কারণে অনেক সময় লজ্জিত হতে হয়। অনেক সময় এর কারণে সমাজ অনেক ধরনের বিবাদ ও বিশৃঙ্খলায়ও পতিত হয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজের গৃহ ছাড়া অন্য কারো গৃহে প্রবেশ কোরো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নেবে এবং গৃহবাসীদের সালাম দেবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো। আর যদি তোমরা সেখানে কাউকে না পাও তাহলে তোমাদের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে প্রবেশ কোরো না। আর যদি তোমাদের বলা হয়, ফিরে যাও, তাহলে ফিরে যাবে। এটাই তোমাদের জন্য অধিক পবিত্রতা। তোমরা যা করো আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২৭-২৮)

অনুমতি ছাড়া কারো গৃহাভ্যন্তরে তাকানো অমার্জনীয় অপরাধ : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কারো ঘরে বিনা অনুমতিতে উঁকি দেবে, তার জন্য ওই ব্যক্তির চোখ ফুঁড়ে দেওয়া বৈধ। (মুসলিম, হাদিস ২১৫৮)

সাহল ইবনে সাদ (রা.) বলেন, একবার এক লোক রাসুল (সা.)-এর কোনো এক কক্ষে উঁকি দেয়। তখন রাসুল (সা.)-এর কাছে একটা ‘মিদরা’ (তথা এক ধরনের চিরুনি) ছিল, যা দিয়ে তিনি তাঁর মাথা চুলকাচ্ছিলেন। তখন তিনি বলেন, যদি আমি জানতাম যে তুমি উঁকি দিচ্ছ, তাহলে এটা দিয়ে তোমার চোখ ফুঁড়ে দিতাম। তাকানোর জন্য অনুমতি গ্রহণের বিধান দেওয়া হয়েছে। (বুখারি, হাদিস ৬২৪১)

অনুমতি না মিললে ফিরে আসা : আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, একবার আমি আনসারদের এক মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ আবু মুসা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এসে বলেন, আমি তিনবার উমর (রা.)-এর কাছে অনুমতি চাইলাম, কিন্তু আমাকে অনুমতি দেওয়া হলো না। তাই আমি ফিরে এলাম। উমর (রা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে ভেতরে প্রবেশ করতে কিসে বাধা দিল? আমি বললাম, আমি প্রবেশের জন্য তিনবার অনুমতি চাইলাম, কিন্তু আমাকে অনুমতি দেওয়া হলো না। তাই আমি ফিরে এলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি তোমাদের কেউ তিনবার প্রবেশের অনুমতি চায়, কিন্তু তাতে অনুমতি দেওয়া না হয়, তাহলে সে যেন ফিরে যায়। তখন উমর (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! তোমাকে এ কথার ওপর অবশ্যই প্রমাণ দিতে হবে। তিনি সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে, যে রাসুল (সা.) থেকে এ হাদিস শুনেছে? তখন উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! আপনার কাছে প্রমাণ দিতে দলের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তিই উঠে দাঁড়াবে, আর আমি দলের সর্বকনিষ্ঠ ছিলাম। সুতরাং আমি তাঁর সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, রাসুল (সা.) অবশ্যই এ কথা বলেছেন। (বুখারি, হাদিস ৬২৪৫)

আপন লোকদেরও বিশেষ কক্ষে প্রবেশে অনুমতি লাগবে : জনৈক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি কি আমার মায়ের ঘরে প্রবেশ করতেও অনুমতি নিতে হবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, অবশ্যই। সাহাবি বলেন, আমি তাঁর সঙ্গে এক ঘরেই থাকি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তার পরও অনুমতি নেবে। সাহাবি বলেন, আমি তার সার্বক্ষণিক সেবক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তার পরও অনুমতি নিতে হবে। তুমি কি তোমার মাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে চাও? সাহাবি বলেন, কখনোই নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তাহলে তুমি অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবে। (মুয়াত্তা মালেক, হাদিস ৭৭৩)

আলী (রা.) বলেন, আমার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকে দুবার প্রবেশের অনুমতি ছিল, দিনে একবার ও রাতে একবার। আমি যখনই রাতে প্রবেশ করতাম, তিনি আমার জন্য গলা খাকারি দিতেন। (নাসাঈ, হাদিস ১২১২)

হাদিসটির এক ব্যাখ্যা অনুসারে মোল্লা আলী কারি (রহ.) এ মর্মে ব্যক্ত করেন, আমি অনুমতির জন্য গলা খাকারি দিতাম। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ৭/২৯৬২)

সুস্পষ্টভাবে নিজের পরিচয় দেওয়া : কারো ঘরে প্রবেশের অনুমতি নিতে যদি ঘরবাসী পরিচয় জিজ্ঞেস করে তখন সুস্পষ্ট পরিচয় দেওয়া সুন্নাত। জাবির (রা.) বলেন, আমার পিতার কিছু ঋণ ছিল। এ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে এলাম এবং দরজায় আঘাত করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? আমি বললাম, আমি। তখন তিনি বলেন, আমি! আমি! যেন তিনি তা অপছন্দ করলেন। (বুখারি, হাদিস ৬২৫০)

দরজা বরাবর না দাঁড়িয়ে ডানে-বাঁয়ে দাঁড়ানো : আবদুল্লাহ ইবনে বুসর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো গোত্রের কাছে এলে সরাসরি দরজায় মুখ করে দাঁড়াতেন না; বরং দরজার ডান অথবা বাঁ পাশে সরে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘আসসালামু আলাইকুম, আসসালামু আলাইকুম।’ কারণ সে যুগে সাধারণত সবার দরজায় পর্দা টানানো থাকত না। (আবু দাউদ, হাদিস ৫১৮৬)

আমাদের সমাজ ও পরিবারের কল্যাণ নিয়ে যাঁরা চিন্তাশীল, তাঁরা কি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এসব বরকতময় সুন্নাত নিয়ে গবেষণায় এগিয়ে আসতে পারেন না? এবং নিজে, পরিবার ও সমাজকে তা পালনে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন না?

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ