অন্যায়ের কাছে মাথানত না করাই কারবালার শিক্ষা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। আর এ মাসের দশম তারিখকে বলা হয় আশুরা। ইসলামের ইতিহাসে আশুরার দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঐতিহাসিক শত শত ঘটনা। কোরআন, হাদিস ও ইসলামের ইতিহাসের তথ্যানুসারে, আসমান-জমিন সৃষ্টি হয়েছে মহররম মাসের দশ তারিখে।

পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে এ তারিখে। এই দিনেই তাকে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠানো হয় এবং সাড়ে তিনশ’ বছর পর্যন্ত কান্নাকাটির পর এই তারিখেই তার তাওবা কবুল হয়েছিল। হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা মহাপ্লাবনের পর জুদি পর্বতে অবতরণ করেছিল এ দিনেই।

হজরত ইবরাহিম (আ.) কে আগুনে নিক্ষেপ এবং সে আগুনকে শান্তিময় পুষ্পকাননে পরিণত করা হয়েছিল এ আশুরার দিনে।

দাম্বিক, জালিম খোদাদ্রোহী ফেরাউনের কবল থেকে নবী মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মুক্তি লাভ এবং ফেরাউনের সলিল সমাধি হয়েছিল এ আশুরার দিনে। হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে এ দিনে আরোগ্য লাভ করেছিলেন।

এদিনেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী কারবালার প্রান্তরে হজরত হোসাইন (রা.) দ্বীনের জন্য সপরিবারে শাহাদত বরণ করেন। এমনকি কিয়ামত দিবসও আশুরার দিনে হবে বলে হাদিসে বর্ণিত আছে।

ইসলাম পূর্ব থেকেই মহররম মাসকে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় বিবেচনা করে লোকরা অন্যায়, অবিচার, জুলুম, অত্যাচার, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রাহাজানি, হানাহানি এবং যুদ্ধবিগ্রহ এড়িয়ে চলত। শুধু মক্কার কোরাইশরা নয় বরং মদিনার ইহুদিরাও মহররমের দশম তারিখকে বিশেষভাবে উদযাপন করত।

হজরত মূসা (আ.)-এর যুগ থেকে রাসূল (সা.) পর্যন্ত এবং তার তিরোধানের পর সুদীর্ঘ বছর ধরে মহররমের ১০ তারিখ আশুরার দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। এরপর ৬১ হিজরি সনের মহররম মাসের ১০ তারিখে ইরাকের কুফা নগরীর ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা।

হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর ইন্তেকালের পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ইয়াজিদ মুসলিম রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করেন। অথচ তার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত ছিলেন হজরত হোসাইন (রা.)। ইয়াজিদ ক্ষমতায় নিয়েই হায়েনার মতো জুলুমের হাত প্রসারিত করে। ফলে সর্বত্র বিদ্রোহ ও অশান্তির দাবানল দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের এই কুশাসন বরদাশত করলেন না। ফলে বেঁধে গেল মিথ্যা ও সত্যের দ্বন্দ্ব।

ইতিমধ্যে ইয়াজিদ মদিনার গভর্নরের মাধ্যমে আদেশ পাঠালো হোসাইন (রা.) যেন ইয়াজিদের প্রতি বাইয়াত গ্রহণ করে। এই সংবাদ শুনে হোসাইন (রা.) মক্কায় হিজরত করেন। এদিকে কুফার একটি বড় জামাত ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ থেকে বিরত থাকল এবং তারা হোসাইন (রা.)-এর হাতে বাইয়াত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

তারা হোসাইন (রা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং কুফায় যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে হোসাইন (রা.)-এর কাছে দেড় শতাধিক চিঠি লিখল। তাদের চিঠি মোতাবেক হোসাইন (রা.) ৭২ জন নারী-পুরুষের এক কাফেলা নিয়ে মক্কা থেকে কুফার দিকে রওনা হন। যাত্রাপথে তিনি ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক মরুভূমিতে ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক ঘেরাও হন। হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের সেনাবাহিনীকে অনেক অনুরোধ করলেও তারা ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ অথবা যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু মানতে অস্বীকার করে।

অবশেষে ৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরে ৪ হাজার ইয়াজিদ সৈন্যের মোকাবেলায় হোসাইন (রা.)-এর নিঃস্ব ৭০ জনের কাফেলা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দাঁড়িয়ে যান। হোসাইন বাহিনীর সবাই বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে দুশমনের মোকাবেলায় একে একে শাহাদাত বরণ করেন। এরপর হোসাইন (রা.) নিজেই ময়দানে আসেন এবং দীর্ঘক্ষণ শত্রু র মোকাবেলায় যুদ্ধ করতে করতে জমিনকে করেন পবিত্র রক্তে রঞ্জিত।

৬১ হিজরির ১০ মহররম শুক্রবার। ৫৬ বছর ৫ মাস বয়সে এই আত্মত্যাগী বীর মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। নিষ্ঠুর ইয়াজিদের সৈন্যরা হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের পরও নির্মম ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।

সেনান বিন আনাস নাখরি হজরতের দেহ থেকে মাথাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। জাহার বিন কাব হজরতের জামা এবং কোমরবন্দ খুলে নেয়। আসওয়াদ আবদি জুতা ও বনী দারাম গোত্রের এক লোক তলোয়ার খুলে নেয়। আর এই দিন থেকেই রচিত হয় ইতিহাসের নির্মম অধ্যায়।

আশুরা আদর্শিক বিজয়ের দিন। শোককে জুলুমের বিরুদ্ধে শক্তিতে রূপান্তরিত করার দিন, যে মুহম্মদি দ্বীন ও আদর্শকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে কারবালার লোমহর্ষ ও হদয়বিদারক ঘটনা হল। সে আদর্শ সত্য ন্যায় ও মুহম্মদী দ্বীন জাগ্রত করার শপথ গ্রহণের দিন আশুরা।

কারবালায় আশুরার আত্মত্যাগে মুসলিম জাতিকে সোনালি যুগের সোনালি আসনের সন্ধান দিয়েছে। এ জাতি যে বিশ্বে সত্য ও ন্যায়ের শাসন কায়েম করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কারবালার ইতিহাস। আশুরা বারে বারে আসে মুসলিম জাতির হৃত ঐতিহ্য শিক্ষা-সংস্কৃতি অনুপ্রেরণা জোগাতে।

আশুরা আসে সমাজদেহে বিরাজিত নৃশংসতা মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে কারবালার ত্যাগের শিক্ষা, অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার শিক্ষা আমাদের চিরন্তন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত।

তাই মর্সিয়া ক্রন্দন নয়, কারবালার বাস্তব শিক্ষা, অর্থাৎ সত্যের জন্য আত্মত্যাগের যে অতুলনীয় শিক্ষা, তা সাদরে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।