অন্ধকারে কাঁদিছে উর্বশী’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

অতসীমামী’ নামে কী এমন গল্প লিখেছিলাম যা ‘বিচিত্রা’ প্রকাশ করেছিল, তা জানার কৌতূহল জাগে অনেকের মনে। গল্পটি শুরু হয় একটি নাটকীয় বাক্যের মধ্যে দিয়ে- “যে শোনে সেই বলে, হ্যাঁ, ‘শোনবার মতো বটে!’” কথাটি বলা হয় কোনো এক বংশীবাদক যতীন্দ্রনাথ রায়ের বাঁশি বাজানো নিয়ে। মেজো মামার কাছ থেকে গল্পের কথক সুরেশ আরো বেশি করে শুনেছে এই বাঁশিবাদকের কথা। মামার কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে তাই সে বালিগঞ্জ থেকে হাজির হয় ভবানীপুরে যতীন্দ্রনাথের বাড়িতে। এ সময় কথকের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় যতীনবাবুর বাড়ির ও তার চেহারার বর্ণনা- “বাড়িটা খুঁজে বার করে আমার তো চক্ষুস্থির! মামার কাছে যতীনবাবুর এবং তাঁর বাঁশি বাজানোর যেরকম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছিলাম তাতে মনে হয়েছিল লোকটা নিশ্চয় একজন কেষ্টবিষ্টু গোছের কেউ হবেন। আর কেষ্টবিষ্টু গোছের একজন লোক যে বৈকুণ্ঠ বা মথুরার রাজপ্রাসাদ না হোক, অন্তত বেশ বড় আর ভদ্র চেহরার একটা বাড়িতে বাস করেন এও তো স্বতঃসিদ্ধ কথা। উইয়ে ধরা দরজার কড়া নাড়লাম। একটু পরেই দরজা খুলে যে লোকটি সামনে এসে দাঁড়ালেন তাঁকে দেখে মনে হলো ছাইগাদা নাড়তেই যেন একটা টকটকে আগুন বার হয়ে পড়ল। খুব রোগা। গয়ের রংও অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু একদিন চেহারাখানা কী রকম ছিল অনুমান করা শক্ত নয়। এখনো যা আছে, অপূর্ব! বছর ত্রিশেক বয়স, কি কিছু কম। মলিন হয়ে আসা গায়ের রং অপূর্ব, শরীরের গড়ন অপূর্ব; মুখের চেহারা অপূর্ব। আর সব মিলিয়ে যে রূপ তাও অপূর্ব। সবচেয়ে অপূর্ব চোখ দুটি! চোখে চোখে চাইলে যেন নেশা লেগে যায়। পুরুষেরও তা হলে সৌন্দর্য থাকে! ইট বার করা নোনা ধরা দেয়াল আর উইয়ে ধরা দরজা, তার মাঝখানে লোকটিকে দেশে আমার মনে হলো ভারি সুন্দর একটা ছবিকে কে যেন অতি বিশ্রী একটা ফ্রেমে বাঁধিয়েছে।”

এ সময় যতীনবাবুর কর্কশ গলার স্বরের বর্ণনাও পাওয়া যায়। এরপর পরিচয় মেলে যতীন্দ্রনাথের স্বভাব-চরিত্রের। দিলদরিয়া ধরনের লোক, মানুষকে আপন করে নেন তিনি অনায়াসেই। বন্ধুর ভাগ্নেকে কাছে পেয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে যান। ডাকেন ভাগ্নে ভাগ্নে বলে। নতুন ভাগ্নে সুরশকে পরিচয় করিয়ে দেন স্ত্রী অতসীর সঙ্গে। সেই সূত্রে সম্পর্কে সুরেশের মামী হয় অতসী। এই অতসীমামীকেই ঘিরেই গড়ে ওঠে গল্পের পটভূমি। দরিদ্র মামার মনটা ছিল অনেক বড়। ভয়াবহ দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে কোনো এক রকম চলছিল তার সংসার। মামীর মুখেই সুরেশ শোনে মামার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য- “ওই রকম স্বভাব ওর। বাক্সে দুটি মোটে টাকা, তাই নিয়ে সেদিন বাজারে গেলেন। বললাম, একটা থাক। জবাব দিলেন, কেন? রাস্তায় ভুবনবাবু চাইতে টাকা দুটি তাকে দিয়ে খালি হাতে ঘরে ঢুকলেন।” এছাড়া অতসীমামী আরো জানায়, বাঁশি বাজালে যতীনবাবুর গলা দিয়ে রক্ত বের হয়। অনেক চেষ্টা করেও মামার বাঁশি বাজানো ছাড়াতে পারেন না মামী। এক জায়গায় এসে সুরেশ ভাবে- “কেবলই মনে হয়, নেশাকে মানুষ এত বড় দাম দেয় কেন। লাভ কী? এই যে যতীন মামা পলে পলে জীবন উৎসর্গ করে সুরের জাল বুনবার নেশায় মেতে যান, মানি তাতে আনন্দ আছে। যে সৃষ্টি করে তারও, যে শোনে তারও। কিন্তু এত চড়া মূল্য দিয়ে কি সেই আনন্দ কিনতে হবে? এই যে স্বপ্ন সৃষ্টি, এ তো ক্ষণিকের! যতক্ষণ সৃষ্টি করা যায় শুধু ততক্ষণ এর স্থিতি। তারপর বাস্তবের কঠোরতার মাঝে এ স্বপ্নের চিহ্নও তো খুঁজে পাওয়া যায় না। এ নিরর্থক মায়া সৃষ্টি করে নিজেকে ভোলাবার প্রয়াস কেন? মানুষের মন কী বিচিত্র! আমরাও ইচ্ছে করে যতীন মামার মতো সুরের আলোয় ভুবন ছেয়ে ফেলে, সুরের আগুন গগনে বেয়ে তুলে পলে পলে নিজেকে শেষ করে আনি! লাভ নেই? নাই বা রইল।”

তবে যতীন মামা ও অতসীমামীর একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অগাধ। একদিন অতসীমামীর টাইফয়েড ধরা পড়ে। চিকিৎকসার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে টাকার। এক পর্যায়ে সুরেশের কাছে বাঁশিটি বিক্রি করে আর বাঁশি না বাজানোর প্রতীক্ষা করেন যতীন মামা। একসময় নিজেদের ভিটেবাড়িটি বিক্রি করে দেশ ছেড়ে চলে যান যতীন মামা ও অতসীমামী। এরপর সুরেশের মন থেকে বিস্মৃত হয় এ দুটি মানুষ। বিয়ে করে সংসারী হয় সুরেশ। তবে অনেক দিন পর ঢাকা মেলে কলিশন (দুই রেলের মাঝে মুখোমুখি সংঘর্ষ) হলে সেখানে মৃতদের নামের তালিকায় যতীন্দ্রনাথ রায়ের নামটি চোখে পড়ে সুরেশের। একদিন ঘটনাচক্রে সুরেশের সাথে ট্রেনে দেখা হয়ে যায় অতসীমামীর। মামীর মুখ থেকেই শুনতে পায় মামার মৃত্যু সংবাদের সত্যতা। প্রতি বছর মামী এ সময়টায় ওই দুর্ঘটনাস্থলে আসেন। সারারাত সময় পার করেন সেখানেই। রাতের অন্ধকারে মামী একসময় নেমে যান ট্রেন থেকে। সুরেশ চলে যায় তার গন্তব্যের দিকে। এভাবেই এক বিচ্ছেদময় দৃশ্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ‘অতসীমামী’ গল্প।

এ গল্পটি নিয়ে আনন্দ ঘোষ হাজরা তাঁর ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প : পরিপ্রেক্ষিত ও উপাদান’ প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে, “[অতসীমামী গল্পে] যতীন মামা বা অতসীমামীর জায়গায় যে কোনো ব্যক্তির নাম আসতে পারে; বাঁশির বদলে কবিতার খাতা, গান ইত্যাদি বসালেও ক্ষতি নেই। গান হলে অবশ্য গানের একটি প্রতীক দরকার হবে, যেমন হারমোনিয়াম বা তানপুরা ইত্যাদি, যেটি বাঁশির মতোই বিক্রয়যোগ্য। কিন্তু এই নির্দিষ্টতা ভেঙে যায় গল্পটির স্তরবিন্যাস ও সমাপ্তির কথা ভাবলে। নানা স্তরের বা বলয়ের সংঘর্ষে গল্পটিতে চমৎকার উজ্জ্বলতা আনে। যেমন, (১) যতীন মামা ও অতসীমামীর ভালোবাসার মানসিক বলয় (২) তাঁদের শিল্পী মনের স্তর (৩) তাঁদের সামাজিক দারিদ্র্যের স্তর (৪) সুরেশের সামাজিক ও মানসিক স্তর। গল্পের সমাপ্তিতে আরো এক ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। মনে হতে পারে যেন গল্পটি বাস্তবকে অতিক্রম করে একটা অতিপ্রাকৃত বা অতিবাস্তবের সীমাস্পর্শ চাইছে। নির্জন ট্রেনে, অন্ধকারময় পটভূমিতে সুরেশ যার দেখা পায়, যাকে সে বাঁশিটি ফেরত দিল সে কি রক্তমাংসের অতসীমামী নাকি সুরেশের মনোপ্রক্ষেপ? পাঠকের মন অনির্দিষ্টতার দোলায় দুলে ওঠে।”

এ পর্যন্ত পড়ে হয়ত সবাই জানতে পারে, ‘অতসীমামী’ গল্পটিই আমার প্রথম প্রকাশিত গল্প। কিন্তু তা পুরোপুরি সত্য নয়। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সেই নতুন তথ্য হাজির করেছে সকলের সামনে। ওখান থেকে প্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-এর ১১ তম খণ্ডে (ডিসেম্বর ২০০৭) মুদ্রিত অগ্রন্থিত গল্পের তালিকায় ‘ম্যাজিক’ নামে একটি গল্প রয়েছে। গল্পটি ‘অতসীমামী’ গল্পের তিন মাস আগে (আশ্বিন ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ, সেপ্টেম্বর ১৯২৮ সাল) প্রকাশিত হয় অশ্বিনীকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক ‘গল্পগুচ্ছ’ পত্রিকায়। মূলত ‘অতসীমামী’ গল্পটি লেখা ও পত্রিকায় পাঠানোর পর পরই এ ‘ম্যাজিক’ গল্পটি লেখা এবং পত্রিকায় পাঠানো হয়েছে। তবে সেটি মুদ্রিত হয় আগে। তবে আরেকটি তথ্যও সেই সাথে যোগ করি, ‘অতসীমামী’ গল্প লেখারও আগে ছাত্রজীবনে আমি ‘জননী’ উপন্যাসটি লিখে মাত্র পঞ্চাশ টাকায় আমি আমার এক বন্ধুর কাছে সেটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। পরে একই নামে সেই উপন্যাস লিখি বটে, তবে তা লেখা হয় সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে। প্রাবন্ধিক শচীন দাশ তাঁর ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প : দুই পর্বের বাস্তবতা’ প্রবন্ধটিতে এ তথ্য জানিয়ে বলেন- “আশা বোধহয় এ-রকমই যে, দুটি উপন্যাসের মধ্যে ব্যবধান নিশ্চয়ই অনেকই। তবু ভাবতে অবাক লাগে, ওই বয়সে তিনি [মানিক] ‘জননী’র মতো উপন্যাসের কথা ভেবেছিলেন এবং কী অনায়াসেই না লিখে ফেলে বন্ধুর কাছে বেচেও দিতে পেরেছিলেন।”

যাই হোক, হঠাৎ গল্প লিখে সম্পাদকের তাগিদে আমি কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী হয়েছি ঠিকই, তবে আমার লেখালেখির শুরু হয় কিন্তু কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। কবিতা চর্চার মাধ্যমে লেখকজীবনের শুরু হওয়ার এ প্রমাণ সকলের কাছে মিলেছে অনেক পরে। কিশোর বয়সে আমি কবিতা লিখেছি অনেক। তারই নিদর্শনস্বরূপ ১০০টি কবিতার সম্পূর্ণ একটি খাতা পাওয়া যায় আমার মৃত্যুর পর ব্যক্তিগত কাগজপত্রের ভেতর।

আমার বয়স তখন ১৬। বন্ধুকে একটি চিঠি লিখি ছন্দ দিয়ে। হায়াৎ মামুদের ভাষায়- “কবিতাটি সুলিখিত, ছন্দ ত্রুটিহীন, কাব্যভাষা প্রাচীনগন্ধী, আর চিঠি বলেই হয়তো-বা বেশ ব্যক্তিগতই।” কবিতাটির শুরুটি এমন :

জানো তো কবিতা লেখা কুঅভ্যাস কিছু ছিল মোর,

এখনো ছাড়িতে তাহা পারি নাই আমি একেবারে,-

সে ভূত কায়েমী হয়ে চাপিয়া রয়েছে মোর ঘাড়ে,

-অর্থাৎ যে নেশা ছিল এখনো কাটেনি তার ঘোর।

 

ওই সময় অনেকে জানতেনই না যে আমি কবিতা লিখেছি, লিখে চলেছি অবিরাম। তবে তা ছিল গোপন। মূলত ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বর ( পৌষ ১৩৪২ বঙ্গাব্দ) মাসে ডিএম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত আমার দ্বিতীয় উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য প্রকাশিত হওয়ার আগে পাঠকরা জানতেনই না আমিও কবিতা লিখতে পারি। কারণ উপন্যাসটির প্রথম ভাগে অর্থাৎ শুরুতেই একটি কবিতা সংযুক্ত হয় ‘দিনের কবিতা’ শিরোনামে।

প্রাতে বন্ধু এসেছে পথিক,

পিঙ্গল সাহারা হতে করিয়া চয়ন

শুষ্ক জীর্ণ তৃণ একগাছি।

ক্ষতবুক তৃষার প্রতীক

রাতের কাজল-লোভী কাতর নয়ন,

ওষ্ঠপুটে মৃত মৌমাছি।

 

স্নিগ্ধ ছায়া ফেলে সে দাঁড়ায়,

আমারে পোড়ায় তবু উত্তপ্ত নিশ্বাস

গৃহাঙ্গনে মরীচিকা আনে।

বক্ষ রিক্ত তার মমতায়

এ জীবনে জীবনের এল না আভাস

বিবর্ণ বিশীর্ণ মরুতৃণে।

 

উপন্যাসের দ্বিতীয় ভাগে ‘রাতের কবিতা’ শিরোনামে আরো একটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়।

প্রেমে বন্ধু পঞ্জরের বাধা,

আলোর আমার মাঝে মাটির আড়াল,

রাত্রি মোর ছায়া পৃথিবীর।

বাষ্পে যার আকাশেরে সাধা,

সাহারার বালি যার ঊষর কপাল,

এ কলঙ্ক সে মৃতা সাকীর।

 

শান্ত রাত্রি নীহারিকা লোকে,

বন্দী রাত্রি মোর বুকে উতল অধীর-

অনুদার সঙ্কীর্ণ আকাশ।

মৃত্যু মুক্তি দেয় না যাহাকে

প্রেম তার মহামুক্তি। -নূতন শরীর

মুক্তি নয়, মুক্তির আভাষ।

 

উপন্যাসটির তৃতীয় ভাগ অর্থাৎ সর্বশেষ ভাগটিও শুরু হয় কবিতা দিয়ে। উপন্যাসের শিরোনামেই এ কবিতাটির শিরোনাম ‘দিবারাত্রির কাব্য’।

অন্ধকারে কাঁদিছে উর্বশী

কান পেতে শোন বন্ধু শ্মশানচারিণী,

মৃত্যু-অভিসারিকার গান;

‘সব্যসাচি! আমি উপবাসী!’

বলি অঙ্গে ভস্ম মাখে সৃষ্টির স্বৈরিণী,

হিমে তাপে মাগে পরিত্রাণ।

 

‘সব্যসাচি! আমি ক্ষুধাতুরা,

শ্মশানের প্রান্ত-ঘেঁষা উত্তর-বাহিনী

নদীস্রোতে চলেছি ভাসিয়া,

মোর সর্ব ভবিষ্যৎ-ভরা

ব্যর্থতার পরপারে। -কে কহে কাহিনী?

মোর লাগি রহিবে বসিয়া?’

 

সূত্র : এনটিভি