অনুশোচনায় ফটো সাংবাদিকের আত্মহত্যা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

প্রিয় মাঠের পাশে লাল নিশান পিকাপ ট্রাকটি থামালেন শেষবারের মতো। এখানেই ফটো সাংবাদিক কেভিন একদিন খেলা করতেন, পড়াশোনা করতেন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেন। তিনি গাড়ি চালু রেখে গাড়ির এক্সিট পাইপের সঙ্গে একটি নল লাগিয়ে তার অপর প্রান্ত চেপে ধরেন নিজের নাকে। সেই নল দিয়ে বেরিয়ে আসা কার্বন মনোক্সাইড বিষ আহরণে মনোযোগ দিলেন তিনি। এরপর আস্তে আস্তে নিভিয়ে দিলেন নিজেকে। মিশে গেলেন সন্ধ্যার আকাশের তারকাদের মাঝে।

১৯৬০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে জন্ম গ্রহণ করেন কেভিন কার্টার। ক্রীড়া ফটো সাংবাদিকতার মধ্যে দিয়ে কর্ম জীবন শুরু করেন তিনি।

১৯৯৩ সালের মার্চে সুদানে দুর্ভিক্ষের ছবি তোলার জন্য অ্যাসাইনমেন্ট পান কেভিন। তখন সুদানে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা প্রতিদিনই বাড়ছে। খাদ্যের অভাবে দিনের পর দিন মানুষ মারা যাচ্ছে। কোথাও কোনো ফসলের ছিটে ফোঁটা নেই। শুধু তীব্র তাপদাহ, কোথায়ও পানি নেই। এরই মধ্যে অ্যাসাইনমেন্টের কাজে সুদানের আয়দ গ্রামে আসেন কেভিন। এখানে রোদের তাপ যেন কংকালসার মানুষের দেহকে পুড়িয়ে দেওয়ার আনন্দে মেতেছে। প্রত্যেকটি মানুষই ত্রাণের খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। কেভিনও সেইদিন সেই অসহায় মানুষগুলোর মুখোমুখি হন।

ক্যামেরার লেন্স ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ আবিষ্কার করলেন এক কংকালসার ক্ষুধার্ত শিশুকে, যে খাদ্যের খোঁজে বেরিয়েছে। তবে এক চুল পরিমাণও হাটার শক্তি নেই শিশুটির। যেন মুখ থুবড়ে উপুড় হয়ে বসে আছে রোদ্দুরের মাঝে। আর শিশুটির ঠিক পেছনে শকুনও ওৎ পেতে আছে শিকারের অপেক্ষায়। প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করে কয়েকটি শট নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন কেভিন। অদূরে একটি গাছের নিচে বসে ধুমপান করতে করতে পরবর্তী কাজের জন্য তৈরি হতে থাকেন। কেভিন শুধু ভেবেছিল স্থিরচিত্র ধারণ করাই তার কাজ।

কেভিনের সেই ছবি প্রথম ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর থেকে হৈ চৈ পড়ে যায়। রীতিমত সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোও নেমে পড়ে ছবির নেপথ্যে। এই ছবির জন্য খ্যাতির চুঁড়ায় পৌঁছে গেলন কেভিন কার্টার। পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নিল তার এই কালজয়ী ছবি।

আর এই জয়ই কাল হয়ে দাঁড়ায় কেভিনের জন্য। কারণ এর পরই কি হলো সেই ক্ষুধার্ত শিশুটির? কিভাবে আপনি ফেলে আসতে পারলেন সে শিশুটিকে?- বিশ্ববাসীর এমন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। এ কারণে ছবিটি তোলার মাত্র তিন মাস পরই আত্মহত্যা করেন তিনি।

মারা যাওয়ার আগে ছোট একটি চিরকুটে তাঁর আত্মহত্যার কারণ লিখে যান কেবিন। চিরকুটে তিনি লেখেন, ‘আমি সত্যিই, একদম সত্যিই দুঃখিত। দুঃখগুলো আমার আনন্দকে অতিক্রম করে কবেই উবে গেছে। আনন্দের কোনো চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই। সত্যিই আমি চরম হতাশ।’

কেভিন কার্টারের আত্মহত্যার কারণ হিসাবে তাঁর সাথে থাকা বিখ্যাত চিত্রসাংবাদিক জোআঁও সিলভা জানিয়েছেন, ‘কার্টার ছবি তুলে আসার আগে সেই শকুনটাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আসেন। তবে ভয়ে তিনি বাচ্চাটিকে ধরেননি। কারণ তিনি এই ভেবে ছিলেন শিশুটি কোনো ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তবে ছবি না তুলে যদি বাচ্চাটিকে নিকটবর্তী ত্রাণশিবিরে নিয়ে গেলে শিশুটি হয়তো বেঁচে যেত এই হতাশায় ও অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেন কেভিন! অথচ শিশুটি সেই সময় মারা যায়নি, আরো ১৩ বছর বেঁচে ছিল। নিয়ং কং নামের ছবির বাচ্চাটি মারা যায় ২০০৭ সালে।